তুলার বিশ্ববাজারে বড় খেলোয়াড় এখন বাংলাদেশ
ফুটি কার্পাস তুলা উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা। এই উনিশ শতক পর্যন্ত সেই তুলা দিয়ে মসলিনের মতো বিশ্বখ্যাত কাপড় উৎপাদিত হতো। মসলিনের সেই দিন আর না থাকলেও বিশ্বের তুলার বাজারে বাংলাদেশ আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভিন্নভাবে। এ বছর তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। চীনের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি করছে বাংলাদেশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৭৬ লাখ বেল তুলা আমদানি করেছে। আর এর জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য উল্লেখ করে জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তুলার বিশ্বে বাংলাদেশ হবে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় বা গুরুত্বপূর্ণ দেশ।
বাংলাদেশ যেভাবে দ্বিতীয়
গত জুলাই মাসে প্রকাশিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থা (ওইসিডি) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ প্রতিবেদন ‘অ্যাগ্রিকালচারাল আউটলুক-২০২১-২০৩০’–এ তুলার বাজার নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তুলার বিশ্ববাণিজ্যে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়ে পরিণত হওয়ার বড় কারণ হিসেবে বাংলাদেশে সুতি কাপড় ও তৈরি পোশাক উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে বিশ্ববাণিজ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। শুধু তা–ই নয়, কাপড় উৎপাদনে চীন ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তন এবং কৃত্রিম তন্তুর কাপড়ের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
তুলার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশে তুলার উৎপাদনও দ্রুত বাড়ছে। তবে এখন পর্যন্ত দেশে মোট চাহিদার খুব সামান্য অংশ দেশে উৎপাদন হয়। গত ১০ বছরে দেশে তুলার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর প্রায় ৪ শতাংশ উৎপাদন বেড়ে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ বেল তুলা। তবে তা দেশের মোট চাহিদার ৫ শতাংশের কম। ফলে মূলত আমদানি বাড়িয়েই বাংলাদেশকে তার চাহিদা মেটাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কটন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক আলহাজ উদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে একসময় ঘরে ঘরে তুলার গাছ ছিল। তবে যে তুলা কাপড় উৎপাদনের জন্য দরকার, তা খুব কম উৎপাদিত হয়। এই তুলার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সম্ভাব্য জমি চিহ্নিত করে চাষিদের তুলা চাষে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করছি।
ওইসিডি ও এফএও–এর ওই প্রতিবেদন বলছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে তুলার যত বাণিজ্য হবে, তার ১৮ শতাংশ একা বাংলাদেশ আমদানি করবে। বাংলাদেশের সমপরিমাণ তুলা অবশ্য এশিয়ার আরেক দেশ ভিয়েতনামও আনবে। চীনকে টপকে এই দুই দেশ তুলার বিশ্বে বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে সুতি কাপড়ের কার্যাদেশ বেড়ে গেছে। ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ২৮ শতাংশ সুতি কাপড়ের উৎপাদন বেড়েছে।
দেশে উৎপাদন বাড়বে
তবে দেশে তুলার উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে আশার কথাও শোনা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক তুলাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা কটন কানেক্ট বাংলাদেশে তুলার উৎপাদনের সম্ভাবনা নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, দেশে তুলার উৎপাদন দেড় লাখ বেল থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১০ লাখ বেল করা সম্ভব। এমনকি সবাই মিলে চেষ্টা করলে এবং দেশের বরেন্দ্র এলাকা এবং চরের জমিগুলোতে তুলার চাষের আওতায় আনলে তুলার উৎপাদন ২০ লাখ বেল করাও সম্ভব।
এ ব্যাপারে কটন কানেক্ট বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ধান ও অন্যান্য ফসলের সঙ্গে তুলনা করলে তুলা উৎপাদনে বেশি সময় লাগে। মোট ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগার কারণে দেশের অনেক এলাকার জমি তুলা চাষের উপযোগী হলেও কৃষকেরা তা চাষ করতে চান না। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করলে অবশ্যই ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদন এই দেশেই সম্ভব।
তুলা নিয়ে গবেষণা
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ইরি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইআইইডি, বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকাড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতের মোট সাতজন গবেষক মিলে বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তুলার উৎপাদনে কিছু ঝুঁকি থাকলেও তা মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়া তুলা উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট উপযোগী উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলার উৎপাদন বাড়াতে দেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ু উপযোগী তুলার বীজ উৎপাদন করতে হবে।
ওই গবেষণা দলের সদস্য এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে ভালো মানের তুলার উৎপাদন সম্ভব, তার প্রমাণ ইতিহাসেই রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলের আগে এখানে সারা দেশেই উন্নত মানের তুলার চাষ হতো। তবে বর্তমান বিশ্ববাজারের উপযোগী এবং পরিবর্তিত আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত তুলার জাত উদ্ভাবনে আমাদের কাজ করতে হবে।’
উপকারী তুলা
এফএওর হিসেবে, বিশ্বে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলা চাষ করা হয়। বিশ্বে তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ৪০তম অবস্থানে রয়েছে। তুলা উৎপাদনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ব্রাজিল অন্যতম। বাংলাদেশে তিনটি শস্য মৌসুমের মধ্যে খরিফ-২তে মাত্র ০.৫২ শতাংশ জমিতে তুলা চাষ করা হয়।
তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্যতেল, খইল, জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। এই ভোজ্যতেলে খুব কম পরিমাণে কোলেস্টরেল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে তেল পাওয়া যায়, যা উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং সয়াবিন তেলের চেয়েও পুষ্টিকর। খইলে রয়েছে উচ্চ প্রোটিন ২৪ শতাংশ, উচ্চ ফ্যাট ২০ শতাংশ হারে এবং ৪০ শতাংশ ক্রুড আঁশ, যা পশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৭ হাজার বেল তুলা উৎপাদিত হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চাষ উপযোগী জমি নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই লাখ হেক্টর।