আসছে বাজেট ২০২১–২২
আয় কম, ব্যয় ও ধার বেশি
অর্থমন্ত্রী আজ ২০২১-২২ অর্থবছরের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করবেন। বাজেট বড় হলেও আয় কম, তাই ধারও থাকবে বেশি।
করোনা মহামারির কারণে গতবারের বাজেট প্রস্তাবনার পুরো পরিবেশটি যেমন অন্য রকম ছিল, অপ্রত্যাশিত হলেও এবারেরটিও তা–ই হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ধারণাই করতে পারেননি, করোনা পরীক্ষা করে, দুই হাত জীবাণুমুক্ত করে এবং শেষে মুখে মাস্ক লাগিয়ে তাঁকে এবারও জাতীয় সংসদে ঢুকতে হবে।
এবারও অর্থমন্ত্রী ব্রিফকেস হাতে সংসদে ঢুকবেন সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে। আজ বৃহস্পতিবার আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরবেন মুস্তফা কামাল। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার অর্থের সংস্থান কম, ফলে ধারই করতে হবে বেশি।
চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্ব ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের। পারা সম্ভব নয় জেনে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা করেছে। কিন্তু সংস্থাটি ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সংগ্রহ করেছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকেও সংগ্রহ ১ লাখ ৩ হাজার ৪১৭ কোটি কম, যা তোলার কথা মে ও জুন—দুই মাসে। কাজটি কঠিন।
আয়ের উৎসের এই দুর্বলতা নিয়েই গতানুগতিকভাবে বড় করা হচ্ছে বাজেট। তবে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছেন না। চলতি অর্থবছরেরমূল লক্ষ্যমাত্রার সমানই তা রাখা হচ্ছে। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক সম্মানী ভাতা ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার করার প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া বয়স্ক ভাতা ও দুস্থ নারীদের জন্য ভাতা দেওয়ার আওতা বাড়ানোর কথা বলা হবে। চলতি অর্থবছরে করোনার কথা চিন্তা করে যেমন ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল রাখা হয়েছিল, আগামী অর্থবছরেও একই আকারের তহবিল থাকছে। তবে হঠাৎ করে কোনো প্রয়োজন হলে যাতে সরকার ব্যয় করতে পারে, সে জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার আলাদা একটি তহবিলের ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
বাড়ছে ব্যয় ও ধার
কিন্তু খরচ তো করতেই হবে। বছর ঘুরলেই আসে অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির চাপ। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি তো আছেই, আরও আছে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়। আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদই দিতে হবে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া আছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন ব্যয়। আবার করোনার কারণে সুরক্ষা সামগ্রী, টেস্টিং কিট থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন কেনা বাবদ বড় ব্যয়ের খাত চলতি অর্থবছরে যেমন ছিল, আগামী অর্থবছরেও থাকবে।
অর্থমন্ত্রী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে আরও বলেন, সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে মাখায় রেখে বাজেট করছেন তিনি। এটা একদিকে হবে জীবন রক্ষার বাজেট, অন্যদিকে জীবিকা রক্ষার বাজেট। তাঁর বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি—সবার জন্য। সবারই অংশীদারত্ব থাকবে এতে।
আগামী অর্থবছরটি চালাতে অর্থমন্ত্রী তাহলে কোন কোন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করবেন? অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী অর্থবছরে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ঋণ নেওয়া হবে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্প সুদের বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। তবে উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকেও ঋণ নেওয়া হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও থাকছে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীদের জন্য যত ছাড়
আগামী অর্থবছরে শুল্ক-করে তুলনামূলক বেশি ছাড় থাকছে। ব্যবসায়ীদের জন্য থাকছে ভালো খবর। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা রাখতে নানা ধরনের কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বড় ছাড় আসছে করপোরেট করে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারও আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ হতে পারে।
এ ছাড়া একক ব্যক্তির কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন অপারেটর, সিগারেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক—এসব খাতের উচ্চ করপোরেট করহারে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। তবে রূপান্তরিত নারী-পুরুষ, বেদে, আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ (কমপক্ষে ১০০ জন বা জনবলের ৫ শতাংশ) কর্মী নিয়োগ করলে করপোরেট করে ৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হতে পারে।
কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন তিন কোটি টাকার বেশি হলে লাভ-লোকসাননির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর দশমিক ৫০ শতাংশ কর দিতে হয়। এটি কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ হতে পারে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্যও থাকতে পারে ছাড়। তাদের ব্যবসা শুরুর প্রথম তিন বছর লাভ-লোকসাননির্বিশেষে দশমিক ১০ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করা হতে পারে।
অন্যদিকে করোনার সময়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নগদ টাকার সরবরাহ বাড়াতে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের আমদানিতে আগাম কর (আগাম ভ্যাট) ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হতে পারে। সময়মতো ভ্যাট রিটার্ন না দিলে জরিমানার পরিমাণ কমানো হচ্ছে। ভ্যাটের টাকার ওপর সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আগামী বাজেটে কালোটাকার সুযোগ সীমিত করা হচ্ছে। শেয়ারবাজার, জমি, নগদ টাকা, এফডিআর-সঞ্চয়পত্রে রাখা টাকাসহ ঢালাও কালোটাকার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে কালোটাকার সুযোগ অব্যাহত থাকবে। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই তিন লাখ টাকা থাকছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ভালো খবর থাকবে। বর্তমানে নারী-পুরুষনির্বিশেষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার কম হলে কোনো কর দিতে হয় না। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এই সীমা ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
কর অবকাশ সুবিধায় নতুন খাত
কর অবকাশ সুবিধায় নতুন নতুন খাত যুক্ত হচ্ছে। কর অবকাশ সুবিধার আওতায় আসছে হাসপাতাল-ক্লিনিকে বিনিয়োগ। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এবং বিভাগীয় শহরের বাইরে কোনো উদ্যোক্তা হাসপাতাল বানালে ১০ বছর কর অবকাশ সুবিধা পাবে।
এ ছাড়া কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ; দুগ্ধ উৎপাদন; দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন এবং খামার যন্ত্রপাতি উৎপাদন খাতও ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পেতে যাচ্ছে। এ ছাড়া গৃহস্থালির ইলেকট্রনিক পণ্য যেমন এসি, ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন বানানোর জন্য কারখানা করলেও কর অবকাশ সুবিধা মিলবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন করে পাঁচ সেবা খাতকে কর অব্যাহতির সুবিধায়ও নিয়ে আসা হচ্ছে। এগুলো হলো ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস এবং ফ্রিল্যান্সিং।
কিছুটা বাধ্যবাধকতা আরোপ
কর ছাড়ের পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে করের বোঝাও বাড়তে পারে। যেমন অতিধনীদের সারচার্জ বাড়ছে। ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে আয়করের ৩৫ শতাংশ সারচার্জ আরোপ হতে পারে।
বর্তমানে ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের রিটার্নের পাশাপাশি আর্থিক বিবরণী বাধ্যবাধকতা নেই। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা হতে পারে। এক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ছয় মাসের মধ্যে ভ্যাট কার্যালয়ে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।
তবে সারচার্জের অন্য স্তরগুলো অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। এখন একজন করদাতা তাঁর বার্ষিক আয়ের ২৫ শতাংশ বা সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত কর রেয়াত নিতে পারেন। ব্যক্তি বিনিয়োগের এই সর্বোচ্চ সীমা এক কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হতে পারে। সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করলে মুনাফার টাকা করমুক্ত করা হতে পারে।
আবার মৎস্য চাষ থেকে ৩০ লাখ টাকার বেশি আয় হলে করহার বেড়ে যাবে। এই হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। বর্তমানে এই খাত থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দিতে হয় না। ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ এবং ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর দেওয়ার বিধান আসতে পারে।
এ ছাড়া সবজি-ফলমূল আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। এই কর আরোপ হলে ফল আমদানিতে খরচ বাড়তে পারে।
দেশে ১৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি বানানো হলে যন্ত্রপাতির আমদানিতে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। একইভাবে মোবাইল ফোন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্য শেষ করবেন পবিত্র কোরআনের একটি সুরা দিয়ে। সুরাটির যে অংশ উল্লেখ করা হবে, তার অর্থ হচ্ছে, ‘হে আল্লাহ, অবশ্যই আমি তোমার কাছে ধবল, উন্মাদ, কুষ্ঠরোগ এবং সব ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’