নতুন মুদ্রানীতি আসছে আগামীকাল, আরও বাড়বে সুদহার

মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। সে জন্য নীতি সুদের হার আরও বাড়ানো হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: সংগৃহীত

আগের মতো সংকোচনমুখী পদক্ষেপ নিয়ে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারও মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হবে, নীতি সুদের হার বাড়ানো ও টাকার সরবরাহ কমানো, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

গত মে মাসে সুদহার বাজারভিত্তিক করার পর এরই মধ্যে তা ১৬ শতাংশে উঠেছে। পাশাপাশি মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে ১১৮ টাকায় উঠেছে। এরপরও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। সে জন্য নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হতে পারে। পাশাপাশি নেওয়া হতে পারে নতুন উদ্যোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হবে। এত দিন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও এবার প্রকাশ করা হবে শুধু ওয়েবসাইটে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তাঁরা এ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সব অনুষ্ঠান বর্জন করে চলেছেন। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এবার ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হবে। সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গত জুনের শেষে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এ জন্য ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়া বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংককে ঠিকই টাকা ছাপিয়ে বিশেষ ধার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে মুদ্রা সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।

এদিকে দেশে এখনো মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকারও সংকট চলছে, রিজার্ভ নিয়েও টানাটানি রয়েছে। তবে ডলারের দামে ছাড় দেওয়ায় বাড়ছে প্রবাসী আয়। রপ্তানি হিসাবে গরমিলের তথ্য ঠিক করায় লেনদেনের ভারসাম্যে চলতি হিসাব ঘাটতিতে চলে গেছে। তবে আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে। এদিকে ব্যাংক খাত এখনো নিয়ন্ত্রণহীন।

মোটাদাগে এসবই হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তারা বছরে দুবার মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার চেষ্টা করে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছর নীতি সুদহার দুই দফা বাড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সরকারের ব্যাংকঋণের সুদে। ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ঋণগ্রহীতাদের ওপর। তাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এভাবে অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেই চেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।

সরকার চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এরই মধ্যে সরকারি ঋণের ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশে ও বন্ডের সুদহার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহারের মাধ্যমে ব্যাংকের সুদহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এখন নীতি সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরো অঞ্চল ও ভারতের মতো বাংলাদেশেও ২০২১ সালের জুন মাসের পর থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার দিকে লক্ষ্য রেখে ২০২২ সালের শেষ দিক থেকেই নীতি সুদহার বাড়াতে থাকে।

বাংলাদেশ ছাড়া প্রতিটি দেশই দ্রুত নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ করেছে ধীরগতিতে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দ্রুত অধিক হারে নীতি সুদহার ততক্ষণ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমে নীতি সুদহারের কাছাকাছি আসা কিংবা আরও নিচে না নামা পর্যন্ত নীতি সুদহারের লাগাম টেনেছে।

একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে খুবই ধীরগতিতে। গত বছরের জুলাইয়ে ঋণের সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা প্রত্যাহারের পর থেকে নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক ধাপ বাড়ানোর পর তারা থেমে যায়, পরে আবার বাড়ায়। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। আসছে নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা পদক্ষেপ নিতে পারবে, এটাই এখন দেখার বিষয়।