প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ হ্রাসে সানেমের উদ্বেগ
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে মোট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকেই জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমাগত কমছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে মোট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাজেটের মাত্র ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, দেশের জ্বালানি খাতকে যে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে, এই পরিসংখ্যানে তার চিত্র পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তারা। সে জন্য এই খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশ করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট বাজেটের মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একই খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ১২ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে।
সানেম বলেছে, বিগত বছরগুলোতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দে উল্লেখযোগ্য ওঠানামা দেখা গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল সর্বোচ্চ; পরবর্তী দুই অর্থবছরে (২০১৯-২০ ও ২০২০-২১) এই খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯১ ও ৩১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমেছে।
জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের সূচনা করা হয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্য; কিন্তু মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিতে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। বিপিডিবির হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে এক টাকা অবমূল্যায়ন ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে ৪৭৩ দশমিক ৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে (১০৭.৭ প্রতি ডলার থেকে ১১৭ প্রতি ডলার) এই বছরের ভর্তুকির বোঝা বেড়ে হতে পারে ৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এই খাতে সরাসরি কর-ব্যয়ের (কর মওকুফ) শতাংশের হিসাবে ইতিবাচক হলেও প্রকৃত পরিমাণ কমেছে। গত অর্থবছরে যা ছিল ১১ হাজার ৯৪২ দশমিক ১৪৭ কোটি টাকা; এবার তা কমে ৭ হাজার ৬১১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বিভিন্ন সরকারি পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাজেটে এর উন্নয়ন ও ব্যবহার বাড়ানোর জন্য মাত্র ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সানেম মনে করছে, এটা পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া স্রেডা গত বছরের তুলনায় কম বরাদ্দ (১১ দশমিক ১৯ কোটি) পেয়েছে; গত বছর যা ছিল ১৪ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা। যদিও এই বরাদ্দ গত বছরের সংশোধিত বাজেটে মাত্র ৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছিল। এতে স্রেডার কার্যকারিতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হয়।
সানেম বলছে, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন সক্ষমতা আরও বৃদ্ধিতে জোর অব্যাহত আছে। বর্তমানে ৯ হাজার ১৪৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মীয়মাণ। নতুন এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণও প্রশ্নবিদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অস্থিতিশীল। ইতিমধ্যে আমাদের অর্থনীতিতে তার গুরুতর প্রভাব অনুভূত হচ্ছে।
সানেম মনে করছে, স্থিতিশীল ও বিকল্প জ্বালানি উৎসের সন্ধান অত্যন্ত জরুরি। স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ৪৮টি কূপ খনন করার পরিকল্পনা করেছে বাপেক্স। কিন্তু ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ বছরে বাপেক্স মাত্র ৪৯টি কূপ খনন করেছে।
এদিকে বাংলাদেশ অফশোর মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং চুক্তি (পিএসসি) ২০২৩ কার্যকর হয়েছে। ৯টি অগভীর ও ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ অফশোর বিডিং রাউন্ড-২০২৪ শুরু হয়েছে। এসব আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ হলেও এতে বেশ অনিশ্চয়তা, কালবিলম্ব ও ব্যয়ের বাহুল্য আছে। সানেম মনে করছে, এ পরিস্থিতিতে দেশের জ্বালানি উৎসগুলো বৈচিত্র্যময় করতে হবে এবং নবায়নযোগ্য সম্ভাবনা অন্বেষণ করতে হবে। কারণ, এটি সবচেয়ে নিশ্চিত ও টেকসই।
জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ পরিচালনায় কৌশলগত পদ্ধতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে সানেম। নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের প্রসার, দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, মুদ্রার অবমূল্যায়নের প্রভাব ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর নীতি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভর্তুকির বোঝা নিরসনে গুরুত্ব দেওয়া হবে যার মূল লক্ষ্য।
সংশোধিত এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের (ইএমআরডি) বাজেট বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে কমছে। সানেম মনে করছে, এর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও এমআরডির জন্য এডিপি ও ভর্তুকির বরাদ্দের হার পরিবর্তন করা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে বলে সানেম মনে করে।