আগামী অর্থবছর থেকে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়তে পারে। বর্তমানে বার্ষিক আয়ের প্রথম তিন লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো কর দিতে হয় না। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে। আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত বাজেটে এ ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সাধারণ করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই চিন্তাভাবনা করছে। এ ছাড়া করপোরেট করহার অপরিবর্তিত থাকতে পারে, বাড়তে পারে দামি গাড়ির শুল্ক।
গতকাল রোববার আগামী বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমসহ এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গণভবনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সভায় আগামী বাজেটে শুল্ক-করসংক্রান্ত যেসব প্রস্তাব আগামী বাজেটের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, এর একটি খসড়া প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর যেন করের চাপ না বাড়ে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৮৭ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) আছেন। তাঁদের মধ্যে ২৯ লাখের মতো টিআইএনধারী প্রতিবছর নিজেদের আয়-ব্যয়ের তথ্য জানিয়ে রিটার্ন দেন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) গড় মূল্যস্ফীতি হলো ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মানে হলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ আগের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো খুবই যৌক্তিক। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য নিচের দিকের (যাঁদের বার্ষিক করযোগ্য আয় তিন থেকে চার লাখ টাকা) করদাতাদের সঞ্চয় নেই খুব একটা। সঞ্চয় না থাকলে কর কীভাবে দেবে? তিনি বলেন, করমুক্ত সীমা কিছুটা বাড়ালে এনবিআরের তেমন একটা রাজস্ব ক্ষতি হবে না। এর পরিমাণ ৩০০-৪০০ কোটি টাকা হতে পারে। তবে সর্বোচ্চ আয়কর হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়ালে এর চেয়ে বেশি কর আসবে।
বাজেটে আরও যা হতে পারে
গতকালের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর কমানো বা বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব রাখছে না এনবিআর। করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে। টানা গত দুই বছর করপোরেট কর কমানো হয়েছে।
এ ছাড়া পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার যে সুযোগ চলতি অর্থবছরে দেওয়া হয়েছে, এর মেয়াদ আর বাড়ানো হচ্ছে না। আগামী ৩০ জুন ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এই পর্যন্ত কেউ এই সুযোগ নেয়নি।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে দামি গাড়ির শুল্ক বাড়ছে। বিশেষ করে ২০০০ থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। আবার যেসব করদাতার দ্বিতীয় গাড়ি আছে, তাঁদের করের হার আরও বাড়তে পারে। বর্তমানে দ্বিতীয় গাড়ির ক্ষেত্রে বিদ্যমান অগ্রিম করের ৫০ শতাংশ বেশি কর দিতে হয়। এটি সিসিভেদে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হতে পারে। কর বাড়তে পারে ২০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা।
এ ছাড়া সিগারেটের মূল্যস্তর ও শুল্ক—দুটি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে আগামী বাজেটে। বাড়তে পারে ভ্রমণ কর।
আদায় বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা
আগামী অর্থবছরে করছাড় উঠিয়ে দেওয়া বা যৌক্তিক করার শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। গতকালের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। এনবিআর সূত্রগুলো বলছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং স্বাস্থ্য খাতের যেসব পণ্য বা কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর নেই, সেখানে হাত দেওয়া হবে না।
আগামী অর্থবছরের এনবিআরকে ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্য আদায়ে এনবিআরের পরিকল্পনা কী, তা নিয়েও গতকালের বৈঠকে আলোচনা হয়। এনবিআরের কর্মকর্তারা এই বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা উপস্থাপন করেন। যেমন আগামী অর্থবছরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মাঠপর্যায়ে ব্যাপকভাবে বসানো শুরু হবে।
গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৯ হাজার ইএফডি মেশিন বসানো হয়েছে। আগামী ছয় বছরে সারা দেশে তিন লাখ ইএফডি মেশিন বসানোর লক্ষ্য আছে। এ ছাড়া চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী করদাতার কাছ থেকেও কর আহরণ বৃদ্ধির পরিকল্পনাও আছে।
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বাড়তি চাপ নেওয়ার অবশ্য কারণও আছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এনবিআরের জন্য সময় ধরে বেশ শর্ত দিয়েছে। যেমন আগামী অর্থবছরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। এর পরিমাণ হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া শুল্ক-করছাড় যৌক্তিক করার উদ্যোগ নিতে হবে।