আসছে বাজেট ২০২৪–২৫
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ‘গোঁজামিল’
আগামী অর্থবছরে ভাতার হার বাড়ছে না, আওতা বাড়ছে সামান্য। এ খাতের সংস্কারবিষয়ক ৯ বছর আগের সুপারিশ ফাইলবন্দী হয়ে আছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করে যখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা একলাফে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছিল, গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষ ভাতা ছিল তখন মাসিক ৪০০ টাকা করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাঁদের ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৫০০ টাকা। বর্তমানে তাঁরা পাচ্ছেন ৬০০ টাকা করে।
টাকার অঙ্কে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ অনেকটা কচ্ছপগতিতে বাড়ছে। কিন্তু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বিবেচনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ খাতে বরাদ্দ বরং কমছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও এ খাতে কোনো সংস্কার আসছে না। আবারও গোঁজামিলের ভিত্তিতেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে সাজাচ্ছে সরকার।
সত্যিকার অর্থে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নয়, আগামী অর্থবছরে এমন কিছু বিষয়কে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের তালিকায় দেখানো হচ্ছে। যেমন ধনী-গরিব সবাই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। আগামী অর্থবছরেও সরকার দেখাতে যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখলে যে হারে সুদ পাওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি হারে যতটুকু সুদ সঞ্চয়পত্রে দেওয়া হয়, ততটুকু হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা।
আবার অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকায় রাখা হচ্ছে। কৃষি খাতে ভর্তুকির পুরো অঙ্ককেই সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বলে বিবেচনা করছে।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য কলোনি নির্মাণ, উপকূল অঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তহবিল গঠন, চাকরিরত অবস্থায় মারা যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের জন্য অনুদান ইত্যাদি খাতের বরাদ্দকেও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
তবে এভাবে দেখিয়েও আগামী অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমছে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ হতে পারে জিডিপির ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। আগের অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং তার আগের অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকা উচিত, তা সরকার করতে পারছে না। ঠিক এ কারণে খাতটিতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়, যা বাস্তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিই নয়।
সুপারিশ আমলে নেওয়া হচ্ছে না
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অধিকতর কার্যকর করতে ২০১৫ সালে সরকার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মাধ্যমে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) প্রণয়ন করে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এনএসএসএসের একটি মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে যে উপযুক্ত না হয়েও ৪৬ শতাংশ ভাতাভোগী সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ভাতা নিচ্ছেন। জিইডি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানিয়েছিল যে দেশের ৬৪ শতাংশ দরিদ্র মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর একটির সুবিধাও পায় না।
এনএসএসএসে যেসব সুপারিশ উঠেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ৯ বছর ধরেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ অনমনীয়। কিছুই আমলে নিচ্ছে না তারা। ফলে বছরের পর বছর ধরে সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে যাচ্ছে সংস্কারবিহীন।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হবে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। নগদ সহায়তা, খাদ্যসহায়তা ও কর্মসৃজন, বৃত্তি, বিশেষ সহায়তা, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের আওতায় ১১৫টি বিষয় বা কর্মসূচি রয়েছে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসৃজন কর্মসূচিতে থাকছে ১১টি বিষয়। এ ছাড়া বৃত্তি বাবদ ৬টি, নগদ ও খাদ্যসহায়তা সংক্রান্ত ১৭টি, ঋণসহায়তার ২টি, বিশেষ সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর ১৩টি, বিভিন্ন তহবিল ও কর্মসূচি ৯টি এবং ৩৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দ রাখার কথা বলা হবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক বজলুল হক খন্দকারের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ যা দেখানো হচ্ছে, তা একধরনের গোঁজামিল। সঞ্চয়পত্রের সুদসহ কয়েকটি বিষয়কে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলে দেখানো হচ্ছে, সেগুলোকে আমরা ধরব না। আমরা হিসাব করে দেখেছি, এ খাতে প্রকৃত বরাদ্দ আসলে জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের মতো। অর্থ বিভাগকেও এ কথা বলেছি।’
বজলুল হক খন্দকার আরও বলেন, ৯ বছর পার হয়ে যাচ্ছে, এনএসএসএসের সুপারিশগুলো আমলে নেওয়া হলো না। অথচ সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সংস্কার রাজস্ব খাতের সংস্কারের মতো এত কঠিন কিছু ছিল না। দরকার শুধু সদিচ্ছার। অনেক কর্মসূচি কমিয়ে খাতটিতে সংস্কার আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আওতা কিছুটা বাড়লেও ভাতা নয়
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু আগামী অর্থবছরে এই প্রস্তাবসহ কোনো ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাবই আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে নগদ সহায়তা বা ভাতা রয়েছে ১০টি শ্রেণিতে। চলতি অর্থবছরে এগুলোতে বরাদ্দ ৪৩ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ চার হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে ১ কোটি ৩৮ লাখের বেশি মানুষের জন্য ১০টি বিষয়ে নগদ সহায়তার বরাদ্দ থাকছে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ অবসরভোগী সরকারি কর্মচারীর পেনশন বাবদ বরাদ্দই ৩০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। তবে উপকারভোগীর সংখ্যা কিছুটা বাড়ানোর চিন্তা থাকলেও আগামী অর্থবছরে বেশির ভাগ শ্রেণির ভাতার ক্ষেত্রেই এই সংখ্যা শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
বর্তমানে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় ৫৮ লাখ ১ হাজার নারী-পুরুষকে। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী বাজেটে ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়ানো হবে। এ ছাড়া বর্তমানে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাকে মাসিক ৫৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। এ ছাড়া মোট ২৯ লাখ প্রতিবন্ধীকে মাসে ৮৫০ টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় টিআর, জিআর, ভিডব্লিউবি, ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভিজিএফ ইত্যাদি ১১টি বিষয়ে ১৬ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে চলতি অর্থবছরে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে ২ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে। অর্থ বিভাগ বলছে, ১১টি বিষয়ে মোট ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫২ হাজার উপকারভোগী রয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে। এতে উপকারভোগী ৬২ লাখ ৫০ হাজার জন। আর ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দের সবচেয়ে বেশি উপকারভোগী ১ কোটি ৮০ লাখ জন হচ্ছে ভিজিএফে।
দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচিটি আর নেই। নাম বদলে চলতি অর্থবছরে এটি করা হয়েছে দুস্থ নারী সহায়তা (ভিডব্লিউবি)। ১০ লাখ ৪০ হাজার জন উপকারভোগীর জন্য চলতি অর্থবছরে এ কর্মসূচিতে ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
অর্থ বিভাগ বলছে, ছয়টি শ্রেণিতে ২ কোটি ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বৃত্তি দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বৃত্তি বরাদ্দ ৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা বাড়তে পারে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ১ কোটি ৪০ হাজার জনকে ২ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের প্রায় ২ হাজার কোটি; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে ৭২ কোটি, কারিগরি শিক্ষার্থীদের ৪৫০ কোটি, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এক লাখ শিক্ষার্থীকে ১১২ কোটি এবং ট্রান্সজেন্ডার, বেদে ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ৩১ হাজার জনকে ৩০ কোটি টাকা বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চা এ খাতে অনুপস্থিত। আমরা দেখছি যে জিডিপির তুলনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ খাতের বরাদ্দ কমছে। এ–ও দেখছি যে ঠিক ব্যক্তির কাছে অর্থ পৌঁছাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে কোনো যথাযথ তদারকি নেই।’