পরিবারপ্রতি ৪,৫৪০ টাকা সহায়তার প্রস্তাব সিপিডির
দেশে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যেসব কর্মসূচি রয়েছে, তা পুরোপুরি কার্যকর নয়। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক উপকারভোগী এসব সহায়তা পান না। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় বাজেট ও অর্থ বিতরণ নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এমন বাস্তবতায় ইউনিভার্সেল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই) বা ‘সর্বজনীন ন্যূনতম আয়’ নামে একটি সমন্বিত সুরক্ষা কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, নতুন এ পদ্ধতিতে দেশের প্রতিটি উপযোগী পরিবার জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম একটি আয় (অর্থসহায়তা) রাষ্ট্র থেকে পাবে। আর এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলে জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার ৬ দশমিক ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। আগামী বাজেট থেকেই স্বল্প বা বিস্তৃত পরিসরে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আজ রোববার আয়োজিত এক সেমিনারে সিপিডির পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রধান কে এ এস মুরশিদ ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।
রাষ্ট্রীয় সহায়তা দরকার, এমন দরিদ্র পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক এককালীন অর্থসহায়তার ব্যবস্থা। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সমন্বয় করে এ কর্মসূচি চালুর সুপারিশ।
অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেন, ‘ইউবিআই নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। তবে বাংলাদেশে এটি আলোচনার টেবিলে আসতে চার দশক সময় লেগেছে। আমরা এখন নতুন সময়ে উপনীত হয়েছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইউবিআই শুধু একাডেমিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং এই কর্মসূচি গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমাদের ন্যূনতম আয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কীভাবে সেটি নিশ্চিত হবে, তা নীতিনির্ধারকেরা ঠিক করবেন। সারা দেশে একবারে করা না গেলেও ধাপে ধাপে এটির বাস্তবায়ন সম্ভব।’
কর্মসূচির নানা দিক
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, দেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। ফলে দারিদ্র্য টেকসইভাবে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সে লক্ষ্যেই ইউবিআই কর্মসূচি প্রস্তাব করা হয়েছে। সিপিডি হিসাব করে দেখেছে, সংশ্লিষ্ট পরিবারের আয়ের পাশাপাশি এসব পরিবারকে মাসে ৪ হাজার ৫৪০ টাকা ন্যূনতম সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। তাতে একটি পরিবার তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইউবিআই শুধু একাডেমিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজনরেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি
মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, জাতীয়ভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বছরে সরকারের ৭৫ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা লাগবে। আর অতি দারিদ্র্যপ্রবণ ১১ জেলায় এটি বাস্তবায়ন করতে ১৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, আগামী বাজেটেই এ কর্মসূচি হাতে নেওয়ার সক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
‘অর্থায়ন সমস্যা নয়’
ইউবিআইয়ের অর্থায়ন বড় কোনো সমস্যা নয় বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অতীতে আমরা প্রকল্পে অপচয় দেখেছি। এমন অনেক বিনিয়োগ হয়েছে, যা থেকে আশানুরূপ ফল (রিটার্ন) পাইনি। বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখায়ও দারিদ্র্য মানুষের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় এ ধরনের কর্মসূচির প্রয়োজন রয়েছে।
কে এস এ মুরশিদ বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে এতগুলো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি না রেখে সমন্বিতভাবে এক ছাতার নিচে আনা গেলে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, অর্থায়ন ও বিতরণ কাজ অনেক সহজ হবে।
নাগরিক হিসেবে আমাদের ন্যূনতম আয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কীভাবে সেটি নিশ্চিত হবে, তা নীতিনির্ধারকেরা ঠিক করবেন।দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘দেশে আজ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা যায়নি। দেশ থেকে যদি এত পরিমাণে অর্থ পাচার হয়, তাহলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যাব কী করে, আর ইউবিআইয়ের মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই–বা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে।’
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, সাধারণত পরিকল্পনায় ত্রুটি ও বাস্তবায়ন দুর্বলতার কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো আশানুরূপ সফল হচ্ছে না।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, করোনার সময়ে এক মোবাইল নম্বরে ৩০০ জনের প্রণোদনা সহায়তা যাওয়ার খবর দেখেছেন। নতুন কর্মসূচিতেও যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষার ভাতা যেন ন্যূনতম মজুরির ওপর চলে না যায়, সেটি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, এ ধরনের কর্মসূচির অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারি তহবিল ছাড়াও বন্ড, বিদেশি সহায়তাসহ উদ্ভাবনী বিভিন্ন পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সামাজিক সুরক্ষাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আনিকা রহমান ও বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সামাজিক সুরক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আইওলি ভ্যালেন্তিনা লুকেজি প্রমুখ।