অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না, নতুন বছরে সরকারের ১১টি করণীয়
বছরের শেষ দিন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবির ট্রাক থেকে বিক্রি হচ্ছিল কয়েক ধরনের পণ্য। দুপুর ১২টা নাগাদ পণ্য কমে এলেও লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল। সারির শেষের দিকে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জানেন না শেষ পর্যন্ত তাঁদের জন্য কিছু থাকবে কি না। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষের কিছুটা সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার এই চেষ্টা ২০২৪ সালের সাধারণ চিত্র। নতুন বছরে সরকার পণ্যমূল্যের রাশ টেনে ধরতে কী ব্যবস্থা নেয়, সেদিকে তাকিয়ে থাকবেন এসব মানুষ।
যে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, তার মূলে ছিল তরুণদের চাকরি না পাওয়ার হতাশা। সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থাকে তাঁরা দেখেছেন বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে, এর অবসানের দাবিতে গড়ে ওঠা গণ–আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। নতুন বছরে এই তরুণরা চাইবেন একটি শোভন কাজ।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। দেশকে ‘উন্নয়নে বিশ্বের রোল মডেল’ হিসেবে দেখানোর যে বয়ান ছিল, তা যে অনেকটাই ফাঁপা ছিল, সেটা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, অন্যদিকে চাকরির যথেষ্ঠ সুযোগ নেই। দেড় দশক ধরে চলা অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিকেই এখন ভঙ্গুর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ফলে নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না।
বিদায়ী বছরটি শুরু হয়েছিল সংকটের মধ্যে, তবে আশাবাদও ছিল। কিন্তু যাকে অলিগার্কি বলে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদেরা, সেই ব্যবস্থার মধ্যে দেশ তলিয়ে যাওয়ার পর সংকট আর চাপ থেকে বের হতে পারেনি অর্থনীতি। ব্যাংক দখল, অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি তোষণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস, প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে অর্থ লোপাট—ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এগুলো নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে এখন দায়িত্ব অর্থনীতির ক্ষত সারানোর, নতুন করে আবার শুরু করার।
দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে যে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের সারমর্ম হচ্ছে, দেশে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যারা দেড় দশক ধরে লুটপাট করেছে। কমিটির হিসাবে এ সময় কেবল বিদেশেই পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ লাখ কোটি টাকা।
অর্থ পাচার অনেকটা অর্থনীতির রক্তক্ষরণের মতো। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা বেশ দুরূহ একটি কাজ। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে আর্থিক খাত থেকে পাচার হওয়া অর্থ চিহ্নিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে, উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোয় গভীর অনুসন্ধান চালানোর। তবে ২০২৫ সালেই এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে—এমন নিশ্চয়তা নেই।
সরকারের অবশ্য বড় কাজ হবে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা করা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে সাধারণ মানুষ। তারা স্বস্তি চায়। তরুণ প্রজন্ম চাইছেন কাজের সুযোগ, সুতরাং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে জন্য আবার দেশি–বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত ঠিক করতে হবে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
সংকটের উত্তরাধিকার
অর্থনীতির যেসব সংকট নিয়ে দেশ নতুন বছরে পা রেখেছে, সেগুলো নতুন নয়। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, ব্যাংক লুটপাট—এসব নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে কিছু পচন ঠেকাতে সফল হয়েছে, কিন্তু লুটপাটের জের শিগগির মিলিয়ে যাচ্ছে না। নতুন বছরে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কারণ, লুকিয়ে রাখা মন্দ ঋণ প্রকাশ্য হবে। ডলারের দাম কোথায় স্থির হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। আর মূল্যস্ফীতিতে দ্রুত লাগাম টানা যাবে—এমন আশা কম।
গত ১৮ নভেম্বর দেওয়া এক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিষণ্ন চিত্রই এঁকেছে। সরকারের ঋণমানের অবনমন করে মুডিস বলেছে, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অন্তত তিনটি সমস্যা তৈরি হতে পারে। এগুলো হলো কম রাজস্ব আয়, বহিস্থ খাতের দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতসংক্রান্ত ঝুঁকি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা হলেও আশাবাদী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করছে, জুনে শেষ হওয়া চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশের তলানিতে নামলেও পরের অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উঠবে। মূল্যস্ফীতি নামবে ৫ শতাংশে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির উত্থান আর মূল্যস্ফীতি পতনের এই বহুল প্রত্যাশিত ঘটনা আগামী বছর থেকেই ঘটতে শুরু করবে।
তবে আমূল সংস্কার না করতে পারলে নতুন বছরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। নানা রকম দাবিদাওয়ার মধ্যে দেশ যখন ‘বায়নাঘর’ হয়ে উঠেছে, তখন সরকার পরিচালনার খরচ বেড়ে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। তাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে সরকারকে আগামী বছর ঋণের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে হবে।
বিনিয়োগের চিত্র হতাশা জাগাচ্ছে
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতার মধ্যে উদ্যোক্তরা বেশ কঠিন সময় পার করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমেছে, ব্যবসা সম্প্রসারণ থমকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেড়ে চলা সুদের হার, অবকাঠামোর ঘাটতি, অনিশ্চয়তা—এসবের মধ্যে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কম। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে, কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলাও। আসছে না বিদেশি বিনিয়োগ। আর এর পরিণামে কমছে কর্মসংস্থান।
নুতন বছরে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকার বদলের পর বন্ধ হয়েছে এমন কিছু কলকারখানা, যেগুলোর মালিকেরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গত জুন শেষে দেশে ২৬ লাখ ৪০ হাজার কর্মক্ষম মানুষ বেকার ছিলেন। কাজ হারিয়ে তাঁদের সঙ্গে নতুন বেকার যোগ হলে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কেবল খারাপই হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কিংবা ব্যবসা–বাণিজ্য চাঙা না করতে পারলে অথবা বিদেশি বিনিয়োগ না আনতে পারলে তরুণদের জন্য চাকরি দূরের স্বপ্ন হয়েই থাকবে।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের সন্ধিক্ষণ
সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা অত্যন্ত সংরক্ষণবাদী। হুমকি দিয়ে রেখেছেন, আমদানি করা পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন। তবে চীন কিংবা মেক্সিকোর মতো দেশের পণ্যে শুল্ক বসবে আরও উঁচু হারে। এ হুমকি বাস্তবে রূপ পেলে তা বাংলাদেশের জন্য সুযোগও বয়ে আনতে পারে। চীনের পণ্যে উচ্চ শুল্ক বসলে সে দেশ থেকে শিল্প অন্য দেশে যাবে। বাংলাদেশকে সেই সুযোগ গ্রহণ করতে হলে ব্যবসা সহজ করা, বন্দর আধুনিকায়ন ও বিনিয়োগপ্রক্রিয়া মসৃণ করতে হবে।
রিজার্ভ ও ডলারে আশার আলো
অন্তর্বর্তী সরকার সাফল্যের মুকুটে আপাতত একটিই পালক—রিজার্ভ পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করেই বেশির ভাগ বিদেশি দায় পরিশোধ করা হয়েছে, পাশাপাশি রিজার্ভও বেড়েছে। ডলারের দামেও মোটামুটি স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে ট্রাম্পের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যদি মূল্যস্ফীতি না কমে, তাহলে সে দেশে নীতি সুদহার খুব একটা কমবে না, আর্থিক বাজারে ডলারের তেজ বজায় থাকবে। ফলে রিজার্ভ ও ডলারের স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
যে ১১ বিষয়ে নজর রাখতে হবে
একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মধ্যে বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদও আছে। ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থনীতি হয়তো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে না, তবে প্রবৃদ্ধির ধারায় অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি এ বছরই শুরু করতে হবে। আর সে জন্য অন্তত ১১টি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
১. আর্থিক খাতে সংস্কার শেষ করা: শেখ হাসিনার সরকারের সময় লুটপাটের শিকার হয়েছে অনেক ব্যাংক। এই খাতে সংস্কার শুরু হয়েছে, তা দ্রুত শেষ করতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
২. মূল্যস্ফীতির রাশ টানা: মাসের পর মাস সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। উচ্চ খাদ্যমূল্যস্ফীতির কারণে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নজর দিতে হবে সরবরাহব্যবস্থার দিকেও।
৩. রাজস্ব খাতের সংস্কার: জরুরি ভিত্তিতে এ কাজ করতে হবে সরকারকে। শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণ করা নয়, সরকারের ঋণনির্ভরতা কমাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে আরও বেশি ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে।
৪. বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবস্থা: দেশি কিংবা বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগই স্থবির হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আস্থার ঘাটতিতে রয়েছেন। একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ উদ্যোক্তাদের পরিষ্কার বার্তা দিতে পারে।
৫. শিল্পের নিরাপত্তা: সরকার পরিবর্তনের পরপরই শিল্পাঞ্চলে যে অস্থিরতা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, তার কিছুটা উপশম হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সন্তোষজনক নয়। নতুন বছরে ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি আশা করবেন।
৬. জ্বালানি ও পরিষেবা: বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দাম নিয়েও রয়েছে অন্তোষ। অন্যান্য পরিষেবা ও অবকাঠামো উন্নতির দিকে এবার নজর দিতে হবে।
৭. কৃষি খাত চাঙা করা: প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু আমদানির উৎস সীমিত হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে হলে স্থানীয় সরবরাহ বাড়াতে হবে।
৮. শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা: লাখ লাখ বিনিয়োগকারী দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে ধুঁকছে। কারসাজি বন্ধ করে বাজারকে স্বাভাবিক করতে হবে।
৯. ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো: দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এখনো যোগাযোগে ঘাটতি রয়েছে।
১০. সুশাসন নিশ্চিত করা: সাবেক সরকারের সময় গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে আর্থিক খাতে সুশাসন ছিল দূরের বিষয়। সে কারণে লুটপাটও করা গেছে নিশ্চিন্তে। এই পথ বন্ধ করতেই দুষ্টের পালন নীতির অবসান ঘটাতে হবে।
১১. কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা: সরকার আগামী ছয় মাস ও এক বছরে কী করতে চায়, তা নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা করা দরকার। অর্থনীতি নিয়ে সরকারের ভাবনা সম্পর্কে এটি একটি পরিষ্কার বার্তা দেবে।