গমের বাজারে অস্থিরতা
নিতাইগঞ্জে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেক মিল
নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে ৭২টি আটা-ময়দার মিল রয়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার ৩৫টি মিল গত ছয় মাসে বন্ধ হয়ে গেছে।
বিশ্ববাজারে গমের বাজারের অস্থিরতা ও আমদানি কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের আটা-ময়দার মিল। শুধু নারায়ণগঞ্জেই গত ছয় মাসে প্রায় অর্ধেক মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এই মিলমালিকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারের অস্থিরতার কারণে একদিকে বেড়েছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে কমেছে চাহিদা। তাই লোকসান কমাতে মিলের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে আটা-ময়দা মিল রয়েছে ৭২টি। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ধাপে ধাপে এসব মিলের মধ্যে ৩৫টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। সচল মিলমালিকেরাও বলছেন, বিশ্ববাজারে গমের দাম ও দেশের আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আরও কিছু মিলের উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। কারণ, ছোট ও মাঝারি মানের মিলের পক্ষে বাড়তি খরচের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন। এমনিতেই এ বাজারের বড় অংশই বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দখলে। সেখানে অস্থিরতা শুরু হলে ছোটদের টিকে থাকা বেশ কঠিন।
মিল বন্ধ হলেও গত ছয় মাসের (ফেব্রুয়ারি-আগস্ট) ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জের বাজারে প্রতি কেজি আটার দাম ১৬ টাকা ও ময়দার দাম ৯ টাকা করে বেড়েছে।
মিলমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আটা-ময়দা-ভোজ্যতেল-চিনি-লবণ ও গো-খাদ্যের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের মিলগুলোতে উৎপাদিত আটা-ময়দা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। ৫০ কেজি ও ৭৪ কেজির বস্তায় এসব আটা-ময়দা বিক্রি করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা গম মিলে ভাঙানোর পর উৎপাদিত আটা-ময়দা পাইকারিতে বিক্রি করেন মিলমালিকেরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম আমদানি বন্ধ ও দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব মিলমালিক ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। লোকসান কমাতে অনেকে মিল বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে গেছেন।
গত বৃহস্পতিবার নিতাইগঞ্জ সরেজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুদ্ধের আগে কানাডার প্রতি মণ গমের দাম ছিল ৯০০ টাকা। এখন সেই দাম বেড়ে হয়েছে দুই হাজার টাকা। রাশিয়ার গম আগে প্রতি মণ ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকায়। ইউক্রেনের গম প্রতি মণ গমের দাম আগে ছিল এক হাজার টাকা, এখন বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা। ভারতের প্রতি মণ গমের দামও ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ টাকা। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা গমের দামও বাড়তি।
গত ছয় মাসে নিতাইগঞ্জের যেসব ফ্লাওয়ার মিল বন্ধ হয়ে গেছে, তার মধ্যে রয়েছে মেসার্স শিল্পী ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স কেবি ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স ইয়াকুব আলী ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স আরশি ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স মামুন ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স রাজ ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স মার্ক ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স মন্টি ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স এসএস ফ্লাওয়ার মিল, মেসার্স শীতল ফ্লাওয়ার মিল ইত্যাদি।
জানতে চাইলে মেসার্স মন্টি ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মেহেদি শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মিলে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০ টন আটা-ময়দা উৎপাদিত হতো। গমের দাম, জ্বালানি খরচ ও গাড়িভাড়া ও শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় মিল চালু রাখলে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছি।
মেসার্স এসএস ফ্লাওয়ার মিলের মালিক সেকান্দার হায়াত বলেন, গমের বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। যেভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তাতে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে খরচ উঠছে না। তাই এ এলাকার প্রায় অর্ধেক মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, গম কেনার পর তা মিল পর্যন্ত আনতে প্রতি বস্তায় খরচ পড়ে ৩৫-৪০ টাকা। অথচ এ খাতের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা জাহাজে লাখ লাখ টন গম আমদানি করে এবং স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তা ভাঙায় বলে তাদের উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়ে। তারা অধিক পরিমাণে আমদানি ও উৎপাদন করে বলে উৎপাদন খরচও কম পড়ে। আবার তারা উৎপাদিত আটা-ময়দা ভোক্তার কাছে সরাসরি পৌঁছে দেন। এ কারণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিতাইগঞ্জের ফ্লাওয়ার মিলের মালিকেরা উৎপাদন খরচে টিকতে পারছেন না। এ কারণে ছোট মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানান, নারায়ণগঞ্জের কোনো ব্যবসায়ী গম আমদানি করেন না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা গম আমদানি করেন। তাঁদের কাছ থেকে বাড়তি দামে গম কিনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করা এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
নিতাইগঞ্জের পাইকারি আটা-ময়দার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, যুদ্ধের আগে প্রতি কেজি আটা বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকায়, সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৪৬ টাকা। ময়দা ছয় মাস আগে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে শুধু ভারত থেকে আমদানি করা গম দিয়ে মিল চলছে। এবারই প্রথম ভারত থেকে আমদানি করা গম নিতাইগঞ্জের মিলে ভাঙানো হচ্ছে।