অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় আরও মূল্যস্ফীতির শঙ্কা
এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।
দুই বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে এই চাপ কড়ায়-গন্ডায় টের পাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের নানা উদ্যোগও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারছে না। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, শাকসবজি, মাছ-মাংসের দাম নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের মধ্যে থাকছে না।
এ অবস্থায় চলমান অনিশ্চয়তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি তথা অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বিপাকে পড়েছে গরিব মানুষ। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় গত কয়েক দিন টিসিবির কার্ডধারী এক কোটি পরিবার ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পাচ্ছে না।
গত কয়েক দিনের সহিংস ঘটনায় দেশের নিত্যপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল। ফলে রাজধানীর বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। কারফিউ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। দুই দিন ধরে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা সচল হতে শুরু করেছে। ফলে রাজধানীর বাজারে পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দামও কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো দুই সপ্তাহ আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি।
দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ অস্বাভাবিক চাপে পড়েছে।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি পড়ে। তাদের সংসার চালানোর খরচ বাড়ে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ অস্বাভাবিক চাপে পড়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। একদিকে সবকিছু বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ নেই; অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম। দিনমজুর শ্রেণির মানুষের দু-তিন দিনের সঞ্চয়ও থাকে না। তাই জিনিসপত্রের বাড়তি দাম উচ্চ মূল্যস্ফীতির যে নতুন সংকট চলছে, তা আরও বাড়িয়ে দিল।
এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে চাপে মানুষ
গত এক যুগের মধ্যে এক বছর ধরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। যে হারে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়ছে না। আয়ের চেয়ে খরচের গতি বেশি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অন্যদিকে জাতীয় মজুরি হার বৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো।
এক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা অর্থবছরের সর্বোচ্চ।
গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য থাকলেও এর ধারেকাছে নেই।
বাজার গরম
গত কয়েক দিনের সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানীতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে বাজারে চাল, ব্রয়লার মুরগি, মুরগির ডিম, মাছ-মাংস, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। অবশ্য গত দুই দিনে শাকসবজির দাম কিছুটা কমেছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বলছেন, বাজার এখনো গরম। দাম এখনো আগের পর্যায়ে আসেনি।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল, কৃষি মার্কেট, শেওড়াপাড়া ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে বিভিন্ন প্রকার চালের দাম কেজিতে ২-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যেমন গতকাল মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে খুচরা পর্যায়ে এক কেজি মোটা চাল (পাইজাম) বিক্রি হয় ৫৪ টাকায়। এই চালের দাম দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫১ টাকা।
রাজধানীর চালের বৃহত্তম পাইকারি আড়ত মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, সংঘাতের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় শুক্রবার থেকে গতকাল পর্যন্ত সেখানে কোনো চালের ট্রাক আসেনি। তবে পাইকারি পর্যায়ে চালের মজুত থাকায় সেখানে দাম স্থিতিশীল রয়েছে। কৃষি মার্কেটের বেঙ্গল রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মো. নাজিম উদ্দিন আশা করেন, খুচরা বাজারে সরবরাহ বাড়লে চালের দাম কমে আসবে।
চাল ছাড়াও অন্য নিত্যসামগ্রী যেমন চিনি, পেঁয়াজ, ব্রয়লার মুরগি, মুরগির ডিমের দাম কিছুটা বেড়েছে। গতকাল ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। মাত্র দুই দিন আগে চিনির দর কেজিতে ৫-১০ টাকা কম ছিল। বাজারে এখন ১১০-১২০ টাকা কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ভারত থেকে আমদানি বাড়লেও পেঁয়াজের দাম কমার কোনো সুখবর নেই।
প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি এখন ১৯০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৭০ টাকা। ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দামও ডজনে ১০-২০ টাকা বেড়ে এখন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত দুই দিনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় সবজির সরবরাহ বেড়েছে। ফলে কমতে শুরু করেছে সবজির দাম। বেশির ভাগ সবজির দাম এখন ১০০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবজির এই দাম এখনো তুলনামূলক অনেক বেশি। মৌসুমের এই সময়ে দাম আরও কম থাকার কথা ছিল।
এদিকে মাছের বাজারেও প্রভাব পড়েছে। গত কয়েক দিনে সরবরাহ কম থাকায় মাছের দাম বাড়তি আছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ রুই, তেলাপিয়া, পাঙাশ ও চিংড়ি মাছ বেশি খায়। এসব মাছের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কেজিতে ২০-৪০ টাকা বাড়তি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকলে দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা আয় বৃদ্ধির দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তবে গত কয়েক দিনে স্থবির হওয়া সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাস, দাম কমবে
কয়েক দিনের সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে বন্ধ থাকার পর গত পরশু থেকে ধীরে ধীরে রাজধানীতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ছে। বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কতটা বাড়ল, তা দেখতে গতকাল বিকেলের দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে সরেজমিন যান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। এ সময় তিনি বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে পণ্যের দাম ও সরবরাহের খোঁজ নেন।
বাজার পরিদর্শন শেষে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সাংবাদিকদের বলেন, এত ধ্বংসযজ্ঞের পরও দ্রুততম সময়ে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক করা হয়েছে। পাইকারি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। এসব পণ্য খুচরা বাজারে গেলে সেখানেও যৌক্তিকভাবে দামও কমে আসবে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, বিশেষ করে কারফিউর মধ্যেও পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো পচনশীল পণ্যের সরবরাহে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, সে জন্য সরকার কাজ করছে। ফলে সরবরাহ নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হবে না বলে আশা করেন তিনি।
বিপাকে কার্ডধারী এক কোটি পরিবার
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে দেশের এক কোটি পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হয়। নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে পরিবেশকেরা পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অ্যাপস সচল করা সম্ভব হচ্ছে না। তিন-চার দিন ধরে সুবিধাভোগীদের কাছে এসব পণ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে বাইরের বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কিনেছেন টিসিবির কার্ডধারী অনেক ভোক্তা।
সার্বিক বিষয় নিয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েক দিনের সহিংস ঘটনা অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি হয়ে গেল। মানুষের মধ্যে একধরনের শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। এখনো ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্যের চলাচল ঠিক করতে পারছি না। নিরাপত্তা জোরদার করে এখন পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করতে হবে। গরিব পরিবারের জন্য বিশেষ সহায়তা ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, দুই বছর ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতা আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসব বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে।