গত বছর ছিল মূল্যস্ফীতির বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে গত বছর। বিশেষ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের দুর্দশার অন্ত ছিল না। রয়টার্সের এক সংবাদে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালের পর ২০২২ সালে খাদ্যের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতি মাসেই খাদ্য মূল্য সূচক প্রকাশ করে থাকে। তাতে দেখা গেছে, ২০২২ সালে এফএওর খাদ্য মূল্য সূচকের গড় মান ছিল ১৪৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট। ১৯৯০ সালে এফএও মূল্য সূচক প্রবর্তন করার পর যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সূচক অনুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মূল্যসূচকের মান ১৮ পয়েন্ট বেড়েছে। এর ফলে ২০২২ সালে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। সব দেশে খাদ্যের দাম একই হারে বাড়েনি। আবার খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব যেসব দেশে একইভাবে পড়েছে, তা-ও নয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। যুদ্ধের কারণে গত বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে খাদ্য পরিবহন ব্যাহত হয়। ফলে এফএওর মূল্য সূচক রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে খাদ্য মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ১৫৯ দশমিক ৭-এ ওঠে।
এরপর এপ্রিল, মে ও জুন মাস পর্যন্ত তা যথাক্রমে ১৫৮ দশমিক ৪, ১৫৮ দশমিক ১ ও ১৫৪ দশমিক ৭ ছিল। আগস্ট মাসে তা এক ধাক্কায় ১৪০-এর ঘরে নেমে আসে। এরপর ধারাবাহিকভাবে খাদ্যের দাম কমতে থাকে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে তা ১৩২ দশমিক ৪-এ নেমে আসে। সামগ্রিকভাবে বছরের গড় মান দাঁড়ায় ১৪৩ দশমিক ৭।
গত বছরের মাঝামাঝি সময় জাতিসংঘের মহাসচিবের উপস্থিতিতে কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহনে রাশিয়া ও ইউক্রেনের চুক্তি হয়। উভয় পক্ষই সম্মত হয়, শস্যবাহী জাহাজে রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউ হামলা করবে না। এই অঙ্গীকারের বরখেলাপ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। তবে সমুদ্রপথে খাদ্যশস্য রপ্তানি একেবারে বন্ধ হয়নি কখনো। এরপর থেকেই খাদ্যের দাম কমতে থাকে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী, এর সময়সীমা ছিল গত বছরের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত।
তবে ১৭ নভেম্বরের পর তা আরও ১২০ দিন বাড়ানো হয়েছে। এতে কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী বন্দরগুলো থেকে শস্যদানা, খাদ্যসামগ্রী ও সার রপ্তানি চলমান আছে। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেন আবার কবে এই চুক্তি লঙ্ঘন করে, তার নিশ্চয়তা নেই। তারা আবার চুক্তি লঙ্ঘন করলে খাদ্য মূল্য আরও বাড়বে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। বৈশ্বিক পরিসরে রুটির ভান্ডার হিসেবে তাদের খ্যাতি আছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যবের ১৯ শতাংশ, গমের ১৪ শতাংশ ও ভুট্টার ৪ শতাংশ তারা রপ্তানি করে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যশস্যের জোগান দেয় এই দুই দেশ। এই দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যের দাম বাড়বে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গত বছর বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিয়েছে। করোনার সময় অনেক দেশ নাগরিকদের প্রণোদনা দিয়েছে। কোনো কোনো দেশে এখনো নানা ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। যেসব দেশে এসব ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেই সব দেশের মানুষের পক্ষে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ধাক্কা মোকাবিলা তুলনামূলকভাবে সহজ হচ্ছে।
২০২২ সালের মার্চ মাসে এফএও বলেছিল, সে বছর খাদ্যপণ্যের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাদের কথাই শেষমেশ সত্যি হলো।