গত এক যুগের মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়িত হয়েছে। এ সময়ে এডিপির মাত্র ২৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে এমন করুণ চিত্রের পেছনে রয়েছে মূলত সম্পদের ঘাটতি ও সক্ষমতার অভাব—এ দুটি বড় কারণ। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের রাজস্ব আদায় আশানুরূপ হচ্ছে না। তাই এডিপিতে নিজস্ব টাকা বা সরকারি অর্থায়নের অংশ কমে গেছে। সরকার নিজেই এখন কৃচ্ছ্র সাধনে রয়েছে। প্রথম সাত মাসে সরকারি অর্থায়নের মাত্র ২৫ শতাংশ খরচ হয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প সাহায্যের খরচ অবশ্য তুলনামূলক বেড়েছে। এই হার ৩০ শতাংশের বেশি। দুই বছর ধরেই এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এর আগে সরকারি অর্থ খরচ বেশি হতো।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এডিপি বাবদ খরচ হয়েছে ৭৪ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পসহ বর্তমানে এডিপির আকার ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এডিপির আকার ২ লখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৩৯২টি।
আইএমইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, বাস্তবায়নের এমন করুণ দশার কারণে এডিপি বরাদ্দের ওপর ছুরি-কাঁচি চালানোর বিকল্প নেই। এবারও তা–ই হচ্ছে। এডিপি থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, এডিপি বাস্তবায়নে মূলত সমস্যা দুটি— সম্পদপ্রাপ্তির অভাব ও সক্ষমতার ঘাটতি বা কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ। এর ওপর কাঙ্ক্ষিত হারে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায় হচ্ছে না। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব, জমিসংক্রান্ত মামলা, বিদেশি ঋণে নানা শর্তারোপ—এসব হলো সক্ষমতার ঘাটতি। যে কারণে দেশে ঐতিহাসিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যায়। এবার এডিপির অর্থ খরচে নীতিনির্ধারকেরা একটু সংযত হয়েছেন। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি তুলনামূলকভাবে কম।
১৩ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সবচেয়ে পিছিয়ে
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ১৩টি নিজেদের বরাদ্দের ২০ শতাংশের কম অর্থ খরচ করতে পেরেছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ; স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ; নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়; শিল্প মন্ত্রণালয়; স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ; ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়; জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়; প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ; তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়; পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বাস্তবায়ন
অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়কাল ধরলে গত ১২ বছরের মধ্যে এবারই এডিপি বাস্তবায়ন হার সবচেয়ে কম। ১২ বছর আগে অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৩ শতাংশ। এরপর এক যুগে কখনো বাস্তবায়ন বেড়েছে, কখনো কমেছে। সাত মাসের হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। গত ১২ বছরের মধ্যে চারবার ৩০ শতাংশের কম এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে।
আকার কমছে ১৮ হাজার কোটি টাকা
এদিকে চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ১৮ হাজার কোটি টাকা কমছে। তাতে সংশোধিত এডিপির আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মূল এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপি অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, সংশোধিত এডিপিতে বিদেশি সহায়তা কমছে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা। ফলে এডিপিতে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর দেশজ উৎসের অর্থ কমছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। তাতে সংশোধিত এডিপিতে দেশজ উৎসের অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গতবারও সংশোধিত এডিপিতে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল।