বছরজুড়ে ডিম-মুরগি-আলু ও পেঁয়াজের দামে ভোগান্তি

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চলছে বেচাবিক্রিপ্রথম আলো ফাইল ছবি

বিদায়ী ২০২৪ সালে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বড় ভিলেন নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দাম কমাতে পারেনি, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তাদের চার মাসের চেষ্টায় তেমন একটা সফল হয়নি। ফলে বছরজুড়ে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বাজারে গিয়ে দামের চাপে পিষ্ট হয়েছেন। মধ্যবিত্তের জীবনও কঠিন ও রূঢ় হয়ে গেছে। তাদের পাত থেকে খাবারের কিছু পদ কমেছে।

নিত্যপণ্যের দাম পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুপারশপগুলো মধ্যবিত্ত গ্রাহক ধরে রাখতে ব্যবসায়িক কৌশল পাল্টেছে। মিনি প্যাক শ্যাম্পুর মতো গরুর মাংস, মাছ, মুরগি, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের কম্বো প্যাকেজ নিয়ে এসেছে, যা দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ ক্রেতাদের অসহায় আত্মসমর্পণের বার্তা দেয়।

সরকার পরিবর্তন, তীব্র তাপপ্রবাহ, একাধিক বন্যা, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি, আমদানি ও জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে বছরজুড়ে দেশে নিত্যপণ্যের বাজার অনেকটাই অস্থিতিশীল ছিল। বিশেষ করে ফার্মের মুরগি ও ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল, সয়াবিন তেল এবং বিভিন্ন সবজির বাড়তি দামে ভোগান্তিতে ছিলেন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা।

নিত্যপণ্যের দাম ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একপর্যায়ে সরকার বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমায়। সরকারের এসব উদ্যোগে বছরের শেষ দিকে এসে কিছু পণ্যের দাম অবশ্য কমেছে। পাশাপাশি তিনটি সংস্থার মাধ্যমে খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল, আটা, তেল, ডিম ও বিভিন্ন সবজি বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে সরকার। তবে চাহিদার তুলনায় এসব পণ্যের পরিমাণ ছিল অনেক কম।

জিনিসপত্রের চড়া দামের কারণে পুরো বছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। একপর্যায়ে তা দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে দেশে গত ১১ মাসের মধ্যে আট মাসেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সরবরাহ সংকট বাড়িয়েছে দাম

বছরজুড়ে কয়েক দফা বন্যা ও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক লাখ মুরগি মারা যায়। এতে একদিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে বাজারে ফার্মের মুরগি ও ডিম সরবরাহে বড় ঘাটতি তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে ডিম-মুরগির দামে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই বছরের পুরো সময়েই প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৮০-২১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও বাজারে ২১০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে। ডিমের দামও বেশ কয়েক মাস ধরে চড়া ছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এক ডজন ডিমের দাম ১৯০ টাকায় ওঠে।

বছরের শেষ দিকে এসে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়। ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলোর দাবির প্রেক্ষাপটে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পরও সয়াবিন তেলের সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

চালের দামও বেড়েছে কয়েক দফায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, এক বছর আগের তুলনায় খুচরা পর্যায়ে সরু ও মাঝারি চালের দাম ১৩-১৪ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৭ শতাংশ বেড়েছে।

আলু-পেঁয়াজও উচ্চ মূল্যে কিনতে হয়

চলতি বছর লম্বা সময় ধরে উচ্চ মূল্যে স্থির ছিল আলু ও পেঁয়াজের দাম। পণ্য দুটির উৎপাদন ও মজুত পর্যাপ্ত থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম কমেনি। টিসিবির পর্যালোচনায় দেখা যায়, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রতি কেজি আলু ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা পরে ৫৫-৬০ টাকায় ওঠে। তবে অক্টোবর মাসে দাম বেড়ে ৮০ টাকায় পৌঁছায় আলুর কেজি। এখন কিছুটা কমে এসেছে। আগের বছরগুলোয় মৌসুমে প্রতি কেজি আলু ১৮-২০ টাকায় ও এরপর ২২-৩০ টাকায় বিক্রি হতো।

অন্যদিকে পেঁয়াজের মৌসুম এবার শুরুই হয়েছিল উচ্চ দামে। গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন পেঁয়াজ ৮০-১০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। এপ্রিলে দাম কিছুটা কমে আবার বেড়ে যায়। নভেম্বরে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের অস্বস্তি হলেও কৃষকদের মুখের হাসি চড়া হয়। অতীতে মৌসুমের শুরুতে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকার নিচে থাকত।

সারা বছর সবজির দামও মানুষকে ভুগিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সবজির দাম অনেকটা সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। তখন প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৩০০-৩৫০ টাকা, বেগুন ১২০-১৮০ টাকা; ঢ্যাঁড়স, পটোল, ধুন্দুল ও চিচিঙ্গা ৮০-১০০ টাকা; কাঁকরোল, করলা ও বরবটি ১২০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। সবজির এমন উচ্চ দামে চরম ভোগান্তিতে পড়েন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আশিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জন্য চলতি বছরের পুরোটাই যেন উত্তপ্ত কড়াই ছিল। আগে বছরের কোনো এক সময় কিছু জিনিসের দাম বাড়ত। কিন্তু গত এক বছরে জিনিসপত্রের দাম এত বেশি ছিল যে ধারদেনা করেও জীবন চালানো কঠিন হয়ে গেছে।’

সরকারের নানা উদ্যোগ

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক করতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ পদক্ষেপ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার, গত সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে। যেমন গত অক্টোবরে চাল আমদানিতে বিদ্যমান তিন ধরনের শুল্ক কমানো হয়। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ ও বিদ্যমান আগাম কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়।

এভাবে সেপ্টেম্বরে আলু আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ ও বিদ্যমান ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। অক্টোবরে ডিম আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ভোজ্যতেল আমদানিতেও বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। আর নভেম্বরে পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক-কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়।

এর পাশাপাশি টিসিবিসহ কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি শুরু করে সরকার। যেমন গত অক্টোবরের শেষ দিকে এসে সাধারণ ভোক্তাদের কাছে ট্রাকে (ঢাকা ও চট্টগ্রামে) করে ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির উদ্যোগ নেয় টিসিবি। অন্যদিকে সবজির দাম বাড়লে গত অক্টোবরে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে ট্রাকে করে সাশ্রয়ী দামে আলু, ডিম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজি বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে চাল-আটা বিক্রির কার্যক্রমও চলে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে সাফল্য পাওয়া যায়নি। মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার তদারকি—এই তিনটির সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।