গাড়ি ব্যবসায়ীরা বিদেশে আস্থা হারানোর ঝুঁকিতে
প্রায় দেড় মাস আগে ছয়টি নতুন গাড়ি আমদানির জন্য দেশের একটি বড় ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিল হকস বে অটোমোবাইলস। এরপর সরবরাহকারীরা গাড়ি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দেশে গাড়ি এসে গেলেও চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংকটি বিদেশি সরবরাহকারীদের ঋণপত্রের টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবদুল হক প্রথম আলোকে জানান, ‘নিয়ম অনুসারে পণ্য জাহাজীকরণের পরেই টাকা পরিশোধ করার কথা আমাদের। অথচ পণ্য দেশে আসার পরও টাকা পরিশোধ হয়নি। এতে আমরা একধরনের খেলাপি হয়ে যাচ্ছি। এভাবে চললে ভবিষ্যতে বিক্রেতারা আমাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করবেন না। পাশাপাশি যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খুলছি, তাদের কাছ থেকেও হয়তো ঋণপত্রের আবেদন নিতে চাইবেন না।’
আবদুল হক আরও বলেন, ‘এ অবস্থায় হয় আমাদের আমদানি করা পণ্য ফেরত পাঠাতে হবে। না হয় আমাদের খেলাপি হিসেবে রপ্তানিকারদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ঋণপত্র বিলম্বিত (ডেফার্ড এলসি) করে ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ সব মিলিয়ে একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়েছেন বলে জানান তিনি।
গত অক্টোবর মাসে ৮টি গাড়ি আমদানির জন্য ৯৯ হাজার ডলারের ঋণপত্র খুলেছিল গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট অটো কারস। এরপর দেড় মাসে মাত্র দুটি গাড়ি আমদানির ঋণপত্র খুলতে পেরেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে, এমন না। তবে ১০০ জন চেষ্টা করলে ৪-৫ জন ঋণপত্র খুলতে পারছেন। তা-ও ৫০-৬০ হাজার ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। এতে আমদানির পরিমাণ ভয়াবহ রকম কমে গেছে।
এভাবে দেশের গাড়ি আমদানিকারকের অনেকেই ঋণপত্র খোলা ও গাড়ি আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এ রকম কয়েকজন প্রথম আলোকে জানান, চুক্তি অনুসারে সরবরাহকারীরা পণ্য পাঠিয়ে দিলেও তাঁরা সঠিক সময়ে ডলার পরিশোধ করতে পারছেন না। চার-পাঁচ মাস ধরে এমন অবস্থা চলছে। এ ছাড়া প্রায় এক মাস ধরে ব্যাংকগুলো নতুন কোনো ঋণপত্র খুলছে না। এতে গাড়ি আমদানি প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
এখন গাড়ি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা প্রায় বন্ধই আছে বলা যায়। যারা এক-দেড় মাস আগে প্রোফর্মা চালান (পিআই) জমা দিয়েছিল, তাদের ঋণপত্র খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে নতুন ঋণপত্রের বিষয়ে ব্যাংকগুলো নিজেরাই নিরুৎসাহিত করছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো ডলার–সংকটকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে।মো. হাবিব উল্লাহ, সভাপতি, বারভিডা
ডলার–সংকট মোকাবিলায় গত জুলাই মাসে গাড়িসহ বেশকিছু বিলাসপণ্য আমদানিতে শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। যোগাযোগ ও যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে। এ অবস্থায় গাড়িকে বিলাসপণ্য মনে করাটা দুঃখজনক। তারপরও ব্যবসায়ীরা শতভাগ মার্জিন দিয়ে গাড়ি আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন টাকা জোগাড় করেও ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁদের।
দেশে নতুন ও রিকন্ডিশন্ড—দুই ধরনের গাড়িই আমদানি ও বিক্রি হয়। জাপানে এক থেকে পাঁচ বছর ব্যবহৃত হওয়ার পর ‘রিকন্ডিশন্ড’ নামে দেশে গাড়ি আমদানি হয়। দেশের গাড়ির বাজারের ৭৫ শতাংশই এ ধরনের গাড়ির দখলে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৯০০ ব্যবসায়ী গাড়ির ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত।
জানতে চাইলে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ বলেন, এখন গাড়ি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা প্রায় বন্ধই আছে বলা যায়। যারা এক-দেড় মাস আগে প্রোফর্মা চালান (পিআই) জমা দিয়েছিল, তাদের ঋণপত্র খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে নতুন ঋণপত্রের বিষয়ে ব্যাংকগুলো নিজেরাই নিরুৎসাহিত করছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো ডলার–সংকটকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে গত ৫ মাসে প্রায় ২ হাজার ২০০টি নতুন গাড়ি ও সাড়ে ১২ হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এসেছে। আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বড় একটি অংশ আসে মোংলা সমুদ্রবন্দর হয়ে। এই বন্দর দিয়ে গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ৮ হাজার ৮২৪টি গাড়ি এসেছে। এর অধিকাংশই রিকন্ডিশনড। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ছয় হাজার গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ১৭৭টি নতুন ও ৩ হাজার ৮২৩টি রিকন্ডিশনড গাড়ি রয়েছে।
মাসভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, কয়েক মাস ধরে আমদানি কমছে। সবচেয়ে কম গাড়ি আমদানি হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। যেখানে প্রতিমাসে তিন হাজারের বেশি গাড়ি আসে, সেখানে সেপ্টেম্বরে আসে মাত্র ১ হাজার ৩৩০টি।
এদিকে ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যাংকগুলো গড়িমসি করছে বলে গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) কাছে অভিযোগ করেন গাড়ি আমদানিকারকেরা। এরপর নভেম্বর মাসে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে ঋণপত্র খোলা ছাড়াই বেশকিছু গাড়ি চলে আসে। ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি নিয়ে তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ জন্য বিভিন্ন উপায়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন তাঁরা।
আমদানি কমার পাশাপাশি দেশের বাজারে গাড়ির দাম বেড়েছে। গত তিন-চার মাসে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে গাড়ি ভেদে দাম ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, শীতমৌসুমে দেশে বিয়েসহ বিভিন্ন উপলক্ষ থাকে। এ কারণে গাড়ি বিক্রি বাড়ে। তবে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গাড়ির দাম ও আমদানি খরচ বেড়েছে। এতে দেশের বাজারে গাড়ির দাম বাড়ছে। সব মিলিয়ে চাপের মধ্যে আছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমদানি কম হচ্ছে, এটা সাময়িক সমস্যা। তবে ঋণপত্র খুলেও সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে, এটাই বড় সমস্যা।’