চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছেন মানুষ

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে মানুষপ্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ কম হওয়ায় মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় এতটা বেড়েছে যে তা অনেক ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে দেশের ১৭ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। মূলত চিকিৎসা বাবদ মানুষের পকেট ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা বাবদ খরচ সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৭ সালে যা ছিল ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২০ সালে ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ; ২০২১ সালে তা ৭৩ শতাংশে উঠে যায়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক আবদুর রাজ্জাক সরকার সম্প্রতি এক সেমিনারে এসব তথ্য দেন। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয়েছে বলে তিনি জানান। স্বাস্থ্য ব্যয় এভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২২ সালে দেশের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা প্রায় ৬১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছিলেন।

বিভিন্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যয়ের কী প্রভাব পড়ছে, গবেষণায় তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ধরে নেওয়া হয়েছে, তা পরিবারের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছে। সেই মাত্রা যে সবার জন্য সমান তা নয়।

আবদুর রাজ্জাক হিসাব করে দেখিয়েছেন, যেসব পরিবারের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ ভোগে ব্যয় হয়, সেই শ্রেণির ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ পরিবার চিকিৎসায় ব্যয় করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। যেসব পরিবারের মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ ভোগে ব্যয় হয়, তাদের ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া যেসব পরিবারের মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হয়, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ পরিবার চিকিৎসার ব্যয় করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আর্থিক চাপে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে ধার করে স্বাস্থ্য ব্যয় নির্বাহ করেছেন ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষ; বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করেছেন ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ আর সম্পদ বিক্রি করেছেন ১৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

নিয়মিত আয় থেকে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নির্বাহ করতে পেরেছেন মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ এবং নিজেদের সঞ্চয় থেকে ব্যয় নির্বাহ করতে পেরেছেন ৩২ দশমিক ৫৮ শতাংশ মানুষ।

গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে গড়ে একটি পরিবারের ৫৫ হাজার ১৩৪ টাকা ব্যয় হয়। হাসপাতালে ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে ওষুধ; এরপর আছে যথাক্রমে সার্জারির ব্যয় ২৩ শতাংশ, রোগনির্ণয়ের ব্যয় ১৭ শতাংশ, বিছানা ভাড়া ১৬ শতাংশ, অন্যান্য ১৪ শতাংশ আর চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যয় ৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দের দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। গ্লোবাল হেলথ এক্সপেনডিচার ডেটাবেজ অনুযায়ী, ২০২১ সালে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। অথচ সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিচ্ছে আফগানিস্তান; জিডিপির ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

চিকিৎসা করে দরিদ্র হওয়া

দেশে চিকিৎসার একমাত্র ভরসা রাজধানী ঢাকা ও হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তা–ও ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে গুরুতর অনেক রোগের চিকিৎসা হয় না। ফলে দেখা যায়, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে দেশের প্রায় সব এলাকার মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। এতে তাদের ভোগান্তি যেমন বাড়ে, তেমনি ব্যয়ও বাড়ে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, গ্রাম ও মফস্‌সলের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসার ব্যয় কমানো কঠিন।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা–বিশেষজ্ঞ ও সম্মান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রুবাইয়ুল মুর্শেদ বলেন, দেশের অন্যান্য খাতের মতো চিকিৎসা খাতেও দুর্নীতি সমান্তরালভাবে এগোচ্ছে। বড় বড় হাসপাতাল ভবন হচ্ছে; কিন্তু যতটা চিকিৎসার মানোন্নয়ন হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে খরচ। চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে একধরনের ‘মেডিকেল পোভার্টি’ বা চিকিৎসাজনিত দারিদ্র্য তৈরি হচ্ছে। মানুষের আয়ু বাড়লেও দেখা যাচ্ছে, বৃদ্ধ বয়সে চিকিৎসার খরচ মেটাতে নিঃস্ব হওয়ার জোগাড় হয়।

রুবাইয়ুল মুর্শেদ আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চিকিৎসকেরা মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কথা না বলে ওষুধ দিয়ে দেন, যার হয়তো প্রয়োজন ছিল না। চিকিৎসকদের মনে রাখা দরকার, সেবার বিষয়টি আগে, উপার্জন পরে। তা না হলে এই পেশার সঙ্গে অন্যান্য পেশার পার্থক্য থাকে না।

এই পরিস্থিতিতে দেশে স্বাস্থ্য খাতে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিমার বিস্তার ঘটানো দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গত কয়েক বছরে দেশের স্বাস্থ্য বিমার কিছুটা প্রসার হলেও এই খাত এখনো এ রকম ফাঁকা পড়ে আছে।