প্রচণ্ড দাবদাহে ব্যাহত মাছের রেণুপোনা, সবজি উৎপাদন
যশোরের হ্যাচারিতে রেণুপোনা উৎপাদন কমে ২৫ শতাংশে নেমেছে। ২১০ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা।
১২ দিন ধরে যশোরে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। প্রচণ্ড এ গরমে যশোরের বিভিন্ন খামারে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে মুরগি। চাঁচড়া মৎস্যপল্লির ৪৫টি হ্যাচারিতে রেণুপোনা উৎপাদনে নেমেছে ধস। এ ছাড়া ২১০ হেক্টর জমির সবজির উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রেণুপোনা উৎপাদনে ধস
দেশের অন্যতম বড় হ্যাচারিপল্লি যশোরের চাঁচড়ায়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশের সাদা মাছের রেণুর মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করেন এখানকার হ্যাচারির উদ্যোক্তারা। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে ১০-১৫ দিনে চাঁচড়া মৎস্যপল্লিতে রেণুপোনা উৎপাদন কমে ২৫ শতাংশে নেমেছে। তাতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন হ্যাচারির মালিক ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্প্রতি চাঁচড়া এলাকার আরিফুল মৎস্য হ্যাচারিতে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের গনগনে রোদে শ্রমিকেরা ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ রেণুপোনার ব্যাগে অক্সিজেন ভরার কাজ করছেন। হ্যাচারির পানির চৌবাচ্চায় ভাসছে মৃত রেণু। শ্রমিকদের চিরচেনা ব্যস্ততা নেই। ক্রেতারাও আসছেন না। তাতে হ্যাচারিজুড়ে একধরনের নীরবতা বিরাজ করছে।
জেলা মৎস্য চাষি ও হ্যাচারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, জেলায় সমিতিভুক্ত রেণুপোনা উৎপাদনের হ্যাচারি রয়েছে ৩০টি। এর বাইরেও ১৫ থেকে ২০টি হ্যাচারি রয়েছে। এসব হ্যাচারিতে চলতি বছর দুই থেকে আড়াই লাখ কেজি রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু গরমের কারণে এই মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশও পূরণ হয় কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান বলেন, ‘ভূগর্ভের পানি তুলে চলমান দাবদাহের মধ্যেও আমরা কিছু প্রজাতির মাছের রেণু উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু ক্রেতা নেই। কারণ পুকুর, খাল, ডোবা, নালায় পানি কমে গেছে। গরমে পানিতে থাকা মাছও মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়িনি। ক্রেতা না থাকায় সক্ষমতার ২৫ শতাংশ রেণুপোনাও এখন উৎপাদন হচ্ছে না। এতে হ্যাচারি মালিকদের ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। শিগগির বৃষ্টি না হলে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
জেলা মৎস্য দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মাছের রেণুপোনা উৎপাদিত হয়। সেখানে তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার রফিকুল আলম বলেন, ‘তীব্র তাপমাত্রার কারণে সরকারি মৎস্য খামারগুলো আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। পোনা উৎপাদনকারীরা হ্যাচারি থেকে রেণু সংগ্রহ করছেন না। কারণ, রেণু নিয়ে পুকুরে ছাড়লেই গরমের কারণে মানা যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা কম।’
মরছে মুরগি
যশোরের সবচেয়ে বড় মুরগির খামার আফিল অ্যাগ্রো। এই খামারে রয়েছে ১৩ লাখ মুরগি। এর মধ্যে ব্রয়লার মুরগি ৬ লাখের বেশি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে প্রথম সাত দিনে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুরগি মারা যায়। ব্যাপক এ মৃত্যু কমাতে একেকটি শেড থেকে ৪ হাজার করে মুরগি সরিয়ে নেওয়া হয়। যেখানে আগে ১৬ হাজার মুরগি রাখা হতো, সেখানে এখন রাখা হচ্ছে ১২ হাজার মুরগি। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তাতে মৃত্যুর হার কিছুটা কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। আগে যেখানে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মুরগি মারা গেছে, সেখানে দিনে ২ হাজার মুরগি মারা যাচ্ছে। তাতেও আমাদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।’
শুধু বড় খামার নয়, প্রান্তিক পর্যায়ের খামারেও একই অবস্থা। জেলার সদর উপজেলার ভাতুড়িয়া গ্রামের খামারি ফিরোজ হোসেন জানান, তাঁর খামারে সাড়ে ৪ হাজার মুরগির মধ্যে ৩৫০টি মুরগি মারা যাওয়ার পর তিনি সব মুরগি বিক্রি করে দেন। এখন নতুন করে আর মুরগি তুলছেন না। গরমের তীব্রতা কমলে আবারও ব্যবসায় নামবেন বলে জানান তিনি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যশোর জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১ হাজার ৫৩৫টি মুরগির খামার রয়েছে। এর মধ্যে ব্রয়লার ১ হাজার ২৯২, লেয়ার ৩৭ ও সোনালি মুরগির খামার রয়েছে ২০৬টি। গরমে সবচেয়ে বেশি মুরগি মারা যাচ্ছে ব্রয়লার খামারে। যদিও খামারিরা মৃত্যুর যে হিসাব দিচ্ছেন, তার সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মিলছে না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১২ দিনে যশোরে মাত্র সাড়ে ৬ হাজার মুরগি মারা গেছে। অথচ আফিল অ্যাগ্রোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের এক খামারেই সাত দিনে দেড় লাখের বেশি মুরগি মারা গেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রাশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রচণ্ড গরমে সব খামারেই কিছু মুরগি মারা যেতে পারে। কিন্তু আফিল অ্যাগ্রো খামারে পৌনে দুই লাখ মুরগি মারা যাওয়ার যে দাবি করা হচ্ছে, তা অবিশ্বাস্য। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত খামারে এত মুরগি মারা যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
সবজির ক্ষতি
সদর উপজেলার চূড়ামনকাঠি এলাকায় ৫০ শতক জমিতে পটোল, ৩০ শতকে চালকুমড়া ও ২০ শতকে লাউ চাষ করেছেন সবজিচাষি মিজানুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দাবদাহের কারণে মাঠে খরা চলছে। ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচযন্ত্রেও ঠিকমতো পানি উঠছে না। তাতে খেতের সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রচণ্ড দাবদাহে সবজির ফুল ও ফল ঝরে যাচ্ছে। লাউ ও চালকুমড়ার গাছ বড় হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর যশোরে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ২১০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে বলে অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে লতাপাতাজাতীয় সবজির গাছের বাড়বাড়ন্ত ব্যাহত হচ্ছে। গাছের ফল ও ফুল ঝরে যাচ্ছে। এতে ফলন কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টি হলে ক্ষতি পুষিয়ে যেতে পারে।