দেশে আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ফলে গত কয়েক বছরে মানুষের জীবনমানের যে উন্নতি হয়েছিল, তার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব মতামত তুলে ধরা হয়। গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশে এখন একধরনের ভয় বা ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। কথা বলতে না–পারা অথবা কথা বলার ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার এবং রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও এ সংস্কৃতি সংক্রমিত হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি কমে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলা হলেও এ উন্নয়নের নিচে চোরাবালি রয়েছে।
প্রান্তিক¯জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে পরামর্শ সভায় পাওয়া মতামত জাতীয়ভাবে তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, প্ল্যাটফর্মের কোর-গ্রুপ সদস্য ও সিপিডির আরেক বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তৃণমূলের মানুষের অবস্থা মূল্যায়নে দেশের ২৫টি জেলায় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার পাঁচ শতাধিক মানুষের মতামত নিয়েছে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তৃণমূলের মানুষের কাছ থেকে ছয়টি বার্তা পাওয়া গেছে। প্রথমত, দেশে যুবসমাজের শোভন কর্মসংস্থানের ঘাটতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাতে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তদের জন্য সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। দ্বিতীয়ত, দেশে বিভিন্ন¯কাজে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়লেও তাদের প্রতি সহিংসতা ও তাদের অধিকারহরণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনের শাসনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, পরিবেশ বিপর্যয় একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে।
সব জায়গায় কোনো না কোনো ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। চতুর্থত, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মান কমেছে। এসব সেবার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কর্মসূচি অন্যতম। পঞ্চমত, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে মূল্যবোধ ছিল, সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দুর্বল জনগোষ্ঠী নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আর তৃণমূলের মানুষের ষষ্ঠ বার্তাটি হচ্ছে, সব জায়গায় একটি ভয় বা ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ভয়ের সংস্কৃতির কারণে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে জবাবদিহির ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। একসময় মধ্যবিত্তরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেরাও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে খাতভিত্তিক কিছু বিষয় সামনে এসেছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা অন্যতম। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তি ও সাক্ষরতার হার বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানে বড় ধরনের পতন হয়েছে। ফলে এ ধরনের শিক্ষা কর্মসংস্থানে কোনো কাজে আসছে না। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভবন থাকলেও চিকিৎসক নেই, আবার চিকিৎসক থাকলে ওষুধ নেই। সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। আয়বৈষম্যের কারণে মাথাপিছু ও সামগ্রিক বরাদ্দ খুবই কম। গ্রামগঞ্জে রাস্তাঘাটের উন্নতি হলেও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আবার নারীর সাইবার নিরাপত্তাঝুঁকিও বাড়ছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ফলে আগে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে মূল্যবোধ তৈরির যে জায়গায় মধ্যবিত্তরা ছিল, এখন আর সেখানে নেই। এটি বড় ধরনের সামাজিক ঘাটতি।
সংবাদ সম্মেলনে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে গড় সমীকরণ সমাজে রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর স্থানীয় মানুষদের উন্নয়নের গড় সমীকরণের কাছাকাছি আনতে ‘ইতিবাচক বৈষম্যমূলক আলোচনা’ হতে হবে। আর সেটি করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে।