উৎসবের অর্থনীতি আমাদের কী জানিয়ে যায়

নামাজের পর খুশিতে কোলাকুলি করছে দুই শিশুফাইল ছবি

বছর ১৫ আগের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কোরবানির ঈদের ছুটিতে যখন বাড়িতে ফিরতাম, তখন দেখতাম, বাসের সহযাত্রীদের মধ্যে বড় অংশই পেশায় কসাই। সিরাজগঞ্জের কোনো রেস্তোরাঁয় বাস যাত্রাবিরতি দিলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পেশার বিষয়টি জানতে পারি। তাঁরা বলতেন, ঈদের দিন ঢাকায় বেশ কয়েকটি গরু কেটে পরদিনই আবার বাড়ি ফিরে আসবেন। এতে রোজগারও ভালো।

বিষয়টি হলো, উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ হয়, কসাইদের এভাবে ঢাকায় আসা সে কারণেই। সেই কসাইরা এখন বিমানযোগেও রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসেন বলে জানা যায়। অর্থনীতিতে ধর্মীয় উৎসবের গুরুত্ব তাই কোনোভাবে কম নয়; বরং গ্রামীণ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় একটি ভিত্তি হচ্ছে উৎসব, বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব। শুধু মুসলিম ধর্মীয় উৎসব নয়, সব ধর্মের ক্ষেত্রেই তা দেখা যায়। বিশেষ করে দেশে এখন যে হাতেগোনা কিছু প্রতিমা কারিগর আছেন, ধর্মীয় উৎসব না থাকলে তাঁদের আয়–রোজগার একপ্রকার বন্ধই হয়ে যেত। অর্থাৎ এই পেশাই হারিয়ে যেত।

এবার অর্থনীতির নীরস প্রসঙ্গে আসা যাক। বাজারে টাকা বা মুদ্রার ফলপ্রসূ ভূমিকা কী, তা বোঝার অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি বা সূচক হলো মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকা হাতবদল হয়ে সমাজে কতটা ঘুরল, সেটা। মুদ্রা যত বেশি হাতবদল হবে, অর্থনীতি তত বেশি গতিশীল হবে। মানুষের হাতে টাকা যাবে, ব্যয় হবে, আরেকজন পাবে—এভাবেই অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, ঈদ, পয়লা বৈশাখ ও পূজা ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে গ্রামকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কৃষক, ব্যবসায়ীর আয় ও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার টাকা অনেক বেশি হাতবদল হয়, অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। ধরা যাক, গরু পালনের সঙ্গে জড়িত ঘাস, প্রাণী খাবার, দুগ্ধজাত পণ্য, চামড়া, মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা, পরিবহনশ্রমিক, দালাল, কসাই, রাখাল, দোকানদার—এ রকম কত কত মানুষ এই মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের অংশীদার, তার নাগাল স্রেফ সংবাদপত্রের ডেস্কে বসে পাওয়া সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান দিয়ে কেবল একটি বিষয়ই প্রমাণ করা যায়; সেটি হলো, ঈদের আগে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া। এই বাড়তি প্রবাসী আয়ের প্রভাব সমাজের কোন স্তরে কতটা অনুভূত হয়, তা বলে বোঝানো মুশকিল।

উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতি থেকে মানুষের যে আয়-রোজগার হচ্ছে, তা দিয়ে গ্রামের চাল, ডাল, কাপড় ও নাম অজানা অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবনের চাকা সচল থাকছে। কোরবানির ঈদের সময় দেশে ফ্রিজের যে ব্যবসা হয়, তার প্রভাব অনুভূত হয় সেই ফ্রিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ভ্যানচালক থেকে শুরু করে পাড়ার রেফ্রিজারেশন মেরামতের মিস্ত্রি পর্যন্ত। এই ঈদকে কেন্দ্র করে এভাবেই অর্থ সমাজে সঞ্চালিত হয়-মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট কাজ করে। আমাদের কোরবানির অর্থনীতির সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, কিন্তু তার মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট অনেক বেশি। এ ছাড়া দেশের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি যে ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, তার পেছনে এই কোরবানি ঈদের অবদান আছে। যদিও চামড়ার সঠিক দাম পাওয়া যায় না বলে বিস্তর অভিযোগ আছে।

পশু জবাই নিয়ে একশ্রেণির মানুষের বিরোধিতা সত্ত্বেও বলা দরকার, কোরবানির পশু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় কর্মসংস্থানের নতুন অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া ও সরকারের নীতিসহায়তার বদৌলতে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ, বেকার যুবক থেকে শুরু করে বড় শিল্পোদ্যোক্তারাও পশুপালনের দিকে ঝুঁকছেন; তাঁদের ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দু এই কোরবানির ঈদ। এই শিল্পের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপকারভোগী বিপুলসংখ্যক মানুষ।

গত কয়েক দিন ঢাকা নগরের পাড়া-মহল্লার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পশুপালনের কী প্রভাব। রাস্তার মোড়ে মোড়ে শত শত মানুষ ছাগল নিয়ে বসে আছেন বিক্রির আশায়। ঢাকার আশপাশ থেকে শুরু করে দেশের দূরদূরান্ত থেকে তাঁরা দুটি-চারটি করে ছাগল ও এমনকি গরু নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। পুরো ঢাকা শহর গত কয়েক দিনে ভ্রাম্যমাণ পশুর হাটে পরিণত হয়। এসব মানুষ এ পশুগুলো পালন করেছেন মূলত কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে। এমনকি দাম-দরে না পোষালে তাঁরা পশুও ছাড়ছেন না। ফেরত নিয়ে চলে যাচ্ছেন। দেশে যে প্রোটিনের চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাতে এসব মানুষ একরকম নিশ্চিত, কোরবানির সময় বিক্রি না হলে পরে বিক্রি করতে সমস্যা হবে না।

উৎসবের অর্থনীতির আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে দানধ্যান। দেশের অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি উৎসব উপলক্ষে গ্রামে বা শহরেও দান করে থাকেন। বিশ্বের অনেক দেশেই এই দানধ্যানের বড় ভূমিকা আছে।

প্রয়াত লেখক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সকরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ শীর্ষক বইতে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দানখয়রাত বিষয়টি ধর্মতত্ত্বের একচেটিয়া দখলে রয়েছে। ...সমাজবিজ্ঞান ইহকাল নিয়ে ব্যস্ত; পরকাল সমাজবিজ্ঞানের চিরাচরিত গণ্ডির বাইরে। যে মূল্যবোধের ওপর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত তা দানখয়রাতের অনুকূল নয়। দানখয়রাতের জন্য প্রয়োজন স্বার্থহীন ব্যক্তি। অর্থনীতির পূর্বানুমান (assumption) হচ্ছে, সকল মানুষই স্বার্থপর।’

অমর্ত্য সেন বারবার বলেছেন, মানুষ নিছক ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয় না। সেটা হলে এই সমাজ টিকত না। বাস্তব জীবনে দান-খয়রাতের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষ বন্ধুবান্ধব, পাড়া–পড়শী ও আত্মীয়স্বজনকে বছরে কত দানখয়রাত করে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে দানখয়রাত বাড়ছে। ওইসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব চেয়ার বা গবেষণা তহবিল আছে, তার বেশির ভাগই ব্যক্তির দানখয়রাতে পরিচালিত। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও দেশে দেশে বাড়ছে। এ নিয়ে রচিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই দানখয়রাত একেবারে উপেক্ষা করার যুক্তি নেই। অর্থনীতিবিদেরা এই শাখার নাম দিয়েছেন ‘ইকোনমিকস অব অলট্রুইজম’ বা পরার্থপরতার অর্থনীতি।

মানুষের ভালো করার ইচ্ছা থাকলেই যে আবার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তা নয়। অর্থনীতির মৌল উপাদান অগ্রাহ্য করে গরিবের কখনো ভালো করা যায় না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বাজার অর্থনীতির মৌল অনুশাসনও মাথায় রাখা দরকার। কীভাবে গরিবের ভালো হয়, সেই পথ নিরাবেগভাবে খুঁজে বের করতে হবে।

তবে সবকিছু অর্থনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। মানুষ এক সতত সৃষ্টিশীল জীব; কোনো নিয়মনীতির বেড়াজালে তাকে আটকে রাখা যায় না। নিজের মতো করে সে পথ খুঁজে নেয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, সে ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। ওই যে মানুষেরা শহরে খাসি বিক্রি করে বিড়ি বা সস্তা সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বাড়ি ফিরবেন, তাদের মুখের অভিব্যক্তি পড়তে হবে। কীভাবে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির মধ্যে নিয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।