দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেট অর্থহীন, নাগরিক প্রতিনিধিদের অভিমত

সিপিডি ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাজেট নিয়ে আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ কথাগুলো বলেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের যৌথভাবে আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ ও বিরাজমান পরিস্থিতি: অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রাপ্তি’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বক্তারা। গতকাল রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনেছবি: প্রথম আলো

আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থহীন বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাঁদের মতে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরক্ষার জন্য বাজেটে কিছু নেই। পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে ধরনের নীতিকৌশল দরকার ছিল, সেগুলোর অভাব রয়েছে বাজেটে। বরং ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে অনেকটাই সাংঘর্ষিক এই বাজেট।

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল সোমবার আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ ও বিরাজমান পরিস্থিতি: অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রাপ্তি’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। এতে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম যৌথভাবে এই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে।

বাজেট প্রণয়নে পেশাদারি আগের চেয়ে অনেক কমেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে নীতিকৌশল দরকার ছিল, সে ধরনের কিছু বাজেটে নেই।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষ থেকে বাজেটে তিনটি বিষয় প্রত্যাশা করা হয়েছিল। প্রথমত প্রত্যাশা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ সচল রাখা, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতিতে ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রবৃদ্ধি সচল রেখে কর্মসংস্থানে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। কিন্তু বাজেটে স্থিতিশীলতার বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। দ্বিতীয়ত প্রত্যাশা ছিল অর্থনীতির কঠিন সময়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরক্ষা। কিন্তু ঘোষিত বাজেটে পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। আর তৃতীয় প্রত্যাশা ছিল অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ও সুরক্ষা দিতে পুঁজিবাজার, ব্যাংকিং, জ্বালানি খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের ঘোষণা থাকবে। কিন্তু বাজেটে সে প্রসঙ্গে কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেই।

বাজেট প্রণয়নে পেশাদারি আগের চেয়ে অনেক কমেছে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, তথ্য–উপাত্তের ব্যবহার, বর্ণনা, যুক্তিকৌশল সব ক্ষেত্রেই দুর্বলতা দেখা গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে নীতিকৌশল দরকার ছিল, সে ধরনের কিছু বাজেটে নেই। নীতি নেতৃত্বের বড় কাজ থাকে সমন্বয়, সেখানেও ক্রমান্বয়ে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এসব সমস্যার মূলে রয়েছে রাজনীতি ও ক্ষমতা। যে রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ হচ্ছে, তা পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে যাচ্ছে না।

বাজেট শুভংকরের ফাঁকি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই বাজেট উচ্চাভিলাষী, বৈষম্যমূলক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থহীন। বাজেট শুভংকরের ফাঁকি, দুর্নীতি সহায়ক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য প্রতিকূল। ক্ষমতাসীন দলের ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্সের বিষয়টিকে স্ববিরোধিতা বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, জিরো টলারেন্সের কথা বলে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া মানুষকে বোকা ভাবা ছাড়া কিছু না। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনার বদলে সরকার বলছে, কেউ প্রশ্ন তুলবে না। ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা দায়ী, তারাই এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তারাই নির্ধারণ করে দেয় ব্যাংকিং খাত কীভাবে উদ্ধার হবে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুখবর নেই

অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের কাছাকাছি। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। কর নিয়ে চাপে থাকা নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য করমুক্ত আয়সীমায় কোনো সুখবর নেই।

শিক্ষা বাজেটের বরাদ্দ অনেকটা বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার মতো বলে মন্তব্য করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।

ওয়াটার এইডের আঞ্চলিক পরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া) মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ১১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যার সবই তৃপ্তির ঢেকুর, দিকনির্দেশনা খুবই কম।

বরাদ্দের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন

জলবায়ু বাজেটের বড় অংশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি। তিনি বলেন, তারা শুধু নীতিনির্ধারণী মন্ত্রণালয়। যে বাজেট তাদের দেওয়া হয়েছে, সেটার বড় অংশই পরিচালন ব্যয়।

জ্বালানি খাতে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে, সেটার যৌক্তিক ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় শিক্ষা ও অর্থনীতি অনুষদের ডিন এ কে এম এনামুল হক।

রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক খাতে জ্বালানি, ব্যাংকিং ও বৈদেশিক রিজার্ভ—তিনটি বড় সমস্যা। সরকার সবচেয়ে চুপ ব্যাংকিং খাত নিয়ে। ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন লেখক ও কলামিস্ট ইলিরা দেওয়ান। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।