করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি, তবে ধনীদের করে আরও ছাড়
বাড়তি রাজস্ব আদায়ের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট প্রস্তাবে ধনীদের ওপর করহার বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেই অবস্থানে তিনি থাকতে পারলেন না। ধনীদের আয়কর হার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হলো। সঙ্গে থাকল কালোটাকা সাদা করার সুযোগও।
জাতীয় সংসদে গতকাল শনিবার অর্থ বিল ২০২৪ পাসের পর দেখা যায়, সর্বোচ্চ আয়কর হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা বাজেট প্রস্তাবে ৩০ শতাংশ ছিল। বছরে যাঁরা ৩০ লাখ টাকার বেশি করযোগ্য আয় করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে হার আগের মতোই থাকল।
অর্থমন্ত্রী ৬ জুন সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এতে রাজস্ব আয়ের জন্য সরকারকে মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহার এবং সিম কেনার ওপর বাড়তি কর আরোপ করতে দেখা যায়। অর্থমন্ত্রী কর বাড়িয়েছিলেন দেশীয় ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারীদের ওপর ও ব্যাংকে জমা রাখা টাকার ওপর। এমনকি বৈদ্যুতিক বাতি, ফলের রস ও আমস্বত্বের মতো পণ্য থেকে বাড়তি কর আদায়ের চেষ্টা রয়েছে বাজেটে। অন্যদিকে বাড়ানো হয়নি করমুক্ত আয়সীমা।
বাজেট ঘোষণার পর মুঠোফোনে বাড়তি কর, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া এবং করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর সমালোচনা হয়। ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ এবং সংসদ সদস্যের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল করে কিছু শুল্ক আরোপের উদ্যোগের বিষয়টির প্রশংসা করা হয়। কিন্তু গতকাল অর্থ বিল পাসের সময় দেখা গেল, মুঠোফোনে কর কমেনি, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি; বরং বাজেটের যেসব প্রস্তাবের প্রশংসা করা হয়েছিল, সেগুলো উল্টে গেছে—ধনীদের কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনার সুযোগ সীমিত করার জন্য এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী দ্য মেম্বার অব পার্লামেন্ট (রেমুনারেশন অ্যান্ড অ্যালাউন্স) অর্ডার সংশোধনের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় আপাতত সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনতে পারবেন।
বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের প্রস্তাবের ভিত্তিতে গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থ বিল পাসের আগে নতুন কিছু সংশোধনী আনেন। তিনি সংসদে বক্তৃতায় বলেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কালোটাকা সাদার সুযোগ রইল
বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। একজন করদাতা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা কিংবা কোনো কারণে আগে ঘোষণা না করা নগদ টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করতে পারবেন। আবার ফ্ল্যাট-প্লট কিনেও এই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে।
অবশ্য সম্পত্তি কেনার মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট হারে কর দিতে হবে। এ ছাড়া কোম্পানিগুলোকেও নিজেদের অপ্রদর্শিত অর্থ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছরের জন্য এই সুযোগ থাকছে।
আয়করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ। এর বিপরীতে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা হয়েছিল। এমনকি জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ এই প্রস্তাবের সমালোচনা করেন।
২২ জুন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রাণ গোপাল দত্ত সংসদে বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে সাধারণ করদাতাদের মধ্যে অনীহা দেখা দেবে। ৩০ লাখ টাকা আয়ে ৩০ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে। কিন্তু যিনি গত বছর টাকা দেখাননি (আয়কর বিবরণীতে), তিনি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেই অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করে নেবেন। এতে সঠিকভাবে যাঁরা কর দিয়ে আসছেন, তাঁরা কর দিতে অনিচ্ছা পোষণ করবেন।
সব সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। তবে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ এই সুযোগ নেননি।
আরও যেসব পরিবর্তন
বাজেট পেশের সময় শহর-গ্রামনির্বিশেষে দেশের যেকোনো স্থানে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করলে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছিলেন, রিটার্ন জমার স্লিপ (প্রমাণপত্র) ছাড়া কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করা যাবে না।
তবে গতকাল অর্থ বিল পাসের সময় এই প্রস্তাবে সংশোধনী আনা হয়েছে। ফলে শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করতে এখন রিটার্ন জমার স্লিপ লাগবে। বিয়েশাদি ছাড়াও বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, গায়েহলুদ, সুন্নতে খতনাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সভা, সেমিনার, পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান করতে সাধারণত কমিউনিটি সেন্টার ও মিলনায়তন ভাড়া করা হয়।
বর্তমানে ৪৩ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার কপি লাগে। এই তালিকায় কমিউনিটি সেন্টার ও মিলনায়তন ভাড়া ছাড়া আরও কয়েকটি খাত যুক্ত করা হয়েছে। যেমন হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নিবন্ধন ও নবায়নে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা এনে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা পাস করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ দূর করতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের বাস্তবতা মাথায় রেখে জাতীয় শুল্কনীতি সংস্কার করছি।’
অর্থ বিলে বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব আনার পাশাপাশি কিছু নতুন প্রস্তাবও পাস হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আয় পুরোপুরি করমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া একজন করদাতা কোনো অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি কর দিলে ওই করদাতার নথি নিরীক্ষায় ফেলা হবে না। এ ছাড়া ট্রাস্টের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর বসবে। ব্যক্তিগত একাধিক গাড়ি থাকলেই কেবল এখন থেকে সারচার্জ বসবে। কোম্পানির গাড়ির ক্ষেত্রে তা আগের মতোই মওকুফ থাকবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক এলাকায় বিনিয়োগকারীরা বিনা শুল্কে বা শূন্য শুল্কে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারতেন। এবারের বাজেটে এসব যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
‘কালোটাকা গ্রহণযোগ্য নয়’
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশই যুক্তিযুক্ত এবং করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকাই ঠিক আছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, যাঁরা কর দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর বাড়তি চাপ না দিয়ে যাঁরা কর দেন না, ফাঁকি দেন, তাঁদের আওতায় আনলে সেটা যৌক্তিক হবে। যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ৬৫ হাজার ডলার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে করমুক্ত আয়সীমা ৫ হাজার ডলার। বাংলাদেশে করমুক্ত আয়সীমা মাথাপিছু আয়ের (২ হাজার ৭৮৪ ডলার বা সোয়া ৩ লাখ টাকা) চেয়ে বেশি।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো সভ্য দেশে এমন সুযোগ থাকতে পারে না। সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির সুযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা একেবারেই অনৈতিক। সাধারণ মানুষ ৪০০-৫০০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানি করা গাড়ি কেনেন, সংসদ সদস্যরা ৪০ শতাংশ শুল্ক দিতে পারবেন না!
বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির বিষয়ে দল-মতনির্বিশেষে সংসদ সদস্যরা এক সুরে কথা বলেন বলেও উল্লেখ করেন আহসান এইচ মনসুর।