এলডিসি উত্তরণে রপ্তানি ক্ষতি হবে ৭০০ কোটি ডলার
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পরের বছর ২০২৭ সালে ব্যাপক রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়বে, যা পরিমাণে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমান বাজারদরে এই ক্ষতি দেশীয় মুদ্রায় দাঁড়াবে ৭৪ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ধরে)।
এখন বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ পণ্য কোনো না কোনোভাবে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধার আওতায় রপ্তানি হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এই অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা ক্রমান্বয়ে হারাতে থাকবে বাংলাদেশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন বেশি প্রভাব পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে। তৈরি পোশাক খাত থেকেই বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় আসে।
যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের কোনো বাজারসুবিধা নেই। কিন্তু ওই বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আছে, বাজার ধরে রেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানিকারকেরা মুনাফা ও দাম কমিয়ে বাজার ধরে রাখতে পারেন।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
জিইডির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারসুবিধার আওতায় বাংলাদেশের পণ্য যে দেশে রপ্তানি হয়, সেখানে শূন্য বা ন্যূনতম কিছু কর দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। শুধু প্রতিবছর যত পণ্য রপ্তানি হয়, এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ৭২ শতাংশ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধায় যায়। জিইডির প্রতিবেদনে একটি উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে যদি রপ্তানিতে বাজারসুবিধা না থাকত, তাহলে তৈরি পোশাক খাতে ১০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হতো। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সাল নাগাদ রপ্তানি বাড়বে, পাশাপাশি ডলারের দামও বাড়বে। তখন বাজারসুবিধা উঠে গেলে সব মিলিয়ে ৭০০ কোটি ডলারের রপ্তানি ক্ষতি হতে পারে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে বাংলাদেশ, এর একটি উদাহরণ হলো জিইডির প্রতিবেদনের চিত্র।
রপ্তানি খাতেই বেশি প্রভাব পড়বে, এমন মত পোষণ করেন অর্থনীতিবিদেরা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের কোনো সুবিধা নেই। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ২০২৯ সাল পর্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা মিলবে। তবে ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ওই বাজারে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ কমার আশঙ্কা রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম রপ্তানি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চারটি সুপারিশ করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের কোনো বাজারসুবিধা নেই। কিন্তু ওই বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আছে, বাজার ধরে রেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানিকারকেরা মুনাফা ও দাম কমিয়ে বাজার ধরে রাখতে পারেন।’ অন্য তিনটি পরামর্শ হলো: এফটিএ, পিটিএ ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব—এসবে নজর দেওয়া; বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং পণ্যের গুণগত মান বাড়ানো।
কারা কী করছে
এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি খাতকে চিহ্নিত করে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রম সমন্বয় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এ জন্য ‘সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
এবার দেখা যাক, কারা কোন খাত নিয়ে কাজ করছে। বিদেশি বিনিয়োগ বিষয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা); অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়; শুল্ক-কর যৌক্তিকীকরণ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ; অগ্রাধিকার বাজারসুবিধা এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ইস্যু নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; মেধাস্বত্ব আইন ও সুবিধার বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়; টেকসই উন্নয়নের কৌশল নিয়ে ইআরডি কাজ করছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো গবেষণা করবে। আর্থিক ও প্রশাসনিক সহায়তা দেবে ইআরডি।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ইআরডির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগে পটভূমি ও করণীয় জানা দরকার। ইআরডি সেই কাজ করছে। ২০২৪ সালের মধ্যেই আশা করি, সব কাজ শেষ হবে।’
জানা গেছে, অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাজারসুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে ডব্লিউটিওসহ বিভিন্ন ফোরামে দর-কষাকষি চলছে। এ ছাড়া ১০টি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা এফটিএ করার জন্য একটি তালিকা তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন ও মালয়েশিয়া। এফটিএ করলে কী সুবিধা হবে, তা নিয়ে গবেষণা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এফডিআই আকর্ষণে চার খাতে অগ্রাধিকার
এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কীভাবে আকৃষ্ট করা হবে, তা নিয়ে গত মাসের মাঝামাঝি বিডায় একটি বৈঠক হয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বেশ কয়েকটি খাত নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে আছে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি, হালকা প্রকৌশল ও সিরামিকস খাত। এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কী ধরনের কর প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হবে, তা নিয়ে একটি গবেষণা করা হবে বলে জানা গেছে।