অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ
ছয় মাসে লাগবে তিন পদক্ষেপ
অর্থনীতিতে সংকট গভীর হয়েছে। সরকারের সক্ষমতা কমেছে, যা রাতারাতি বাড়ানো যাবে না। সুনির্দিষ্ট নীতির আলোকে এগোতে হবে।
নির্বাচনের বছরে অর্থনীতিতে চাপ কমাতে প্রয়োজন রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার মতো বিষয় এখনো ঝুলে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে, এই আশায় গত এক বছরে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এখন সংকট থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের পাশাপাশি আগামী ছয় মাসে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে পিআরআইয়ের সম্মেলনকক্ষে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ করে গবেষণা সংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও আগামী দিনের করণীয় কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়।
অর্থনীতির বর্তমান সংকটগুলো থেকে উত্তরণের জন্য পিআরআই আগামী ছয় মাসে করণীয় হিসেবে যে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরে, সেগুলো হচ্ছে—এক. রাজস্ব ঘাটতি কমাতে সরকারের ব্যয় সংকোচন। দুই. ডলারের বাজারে অস্থিরতা কমাতে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়া। তিন. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমান বাস্তবতায় প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একধরনের উচ্চাশা। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ–জিডিপির অনুপাত ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানোর চিন্তা প্রায় অসম্ভব।
বাণিজ্যঘাটতি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অন্তত চার লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে। যেটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কষ্টসাধ্য। সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও অসম্ভব বলে মনে করে পিআরআই।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের আশ্বাসে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। মার্কিন ডলারের সংকট এখনো চলমান। সরকারকে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ বাবদ আগামী অর্থবছরে ১ লাখ কোটি টাকার মতো দিতে হবে, যা ২০২২–২৩ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ। বিভিন্ন প্রয়োজনে গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, গত ৫০ বছরে তা নেওয়া হয়নি। এদিকে ব্যাংক খাতেও পর্যাপ্ত টাকা নেই। এতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমছে।
এসব সংকটের কথা অনেক দিন ধরে সামনে আনা হলেও সেটাকে সরকার সতর্কবার্তা হিসেবে নেয়নি উল্লেখ করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, সতর্কতা আমলে না নেওয়ায় অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হয়েছে। এতে সরকারের সক্ষমতা কমেছে।
এখন রাতারাতি তা বাড়ানো যাবে না। কারণ, সরকারের ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, আয় সেভাবে বাড়েনি। তাই প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে হবে। প্রয়োজন হলে বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে হাত দিতে হতে পারে। তা না হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ঠিক রাখা কঠিন হবে।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘সামনে মুদ্রানীতি আসছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার কোনো চিন্তা করা হবে কি না। কারণ, এটা করতে গেলে ব্যবসায়ীরা বাধা দেন। তাঁরা সস্তায় ব্যবসা করে আরও বড় হতে চান। কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সুদহার নির্ধারণ করে বলে আমার জানা নেই।
যদিও দিনশেষে এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নির্বাচনের বছর বলে মুদ্রানীতিতে সুদহারের বিষয়টি ঝুলে থাকলে তা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। সুদহারের সীমা বাড়লে বেসরকারি বিনিয়োগ কমতে ও ঋণখেলাপি বাড়তে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।
আর নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে গেলে কর–জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে। এ জন্য বাড়াতে হবে করজাল। সেটি আবার রাতারাতি করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে পিআরআই আরও জানায়, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদ্যুৎ খাতে বাড়তি ৪৭৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া লাগবে। টাকার অবমূল্যায়ন সরকারের ঋণ পরিশোধের খরচও বাড়াবে।