বিশ্বে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে—এমন অভিযোগ একসময় মার্ক্সবাদীরা করতেন। এখন বিশ্বব্যাংক ও অক্সফামের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব কথা বলছে। সর্বশেষ আলট্রাটা নামের একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, গত বছর বিশ্বে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
আলট্রাটার প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। তাতে বিশ্বব্যাপী অতিধনী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৩০। বাস্তবতা হলো ২০২৩ সালে বিশ্বে অতিধনী মানুষের সংখ্যা পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় প্রবৃদ্ধির গতি কমলেও অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা গেছে। গত বছর অতিধনীদের সম্পদমূল্য ৭ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন বা ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বেড়ে ৪৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বা ৪৯ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি ধনীর বসবাস। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ অতিধনী বাস করেন এ দেশে। ২০২৩ সালে সে দেশে অতিধনীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯৫০ জনে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে ইউরোপের দেশ জার্মানিতেও অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে। সেখানেও প্রায় সমহারে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে চীনে অতিধনীর সংখ্যা গত বছর ১ শতাংশ কমেছে। মূলত দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় অতিধনীর সংখ্যা কমেছে। তবে এশিয়ার অন্য দুই বড় অর্থনীতি জাপান ও ভারতে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে।
আলট্রাটা ভারতের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে। বলেছে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের যে ১০টি শহরে সবচেয়ে বেশি হারে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বাড়বে, তার মধ্যে তিনটিই হবে ভারতের। গত বছর বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই ছিল সবচেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরেও দেশটি উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় সে দেশে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ ও দিল্লির মতো শহরে প্রতিবছর গড়ে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ হারে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এ ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য শহরের মধ্যে ফিলিপাইনের ম্যানিলা ও মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি শহরের মধ্যে এগুলো থাকবে।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে উত্তর আমেরিকা। এই অঞ্চলে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে এ অঞ্চলে অতিধনী মানুষ বেড়েছে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে এখন সারা বিশ্বে যত অতিধনী মানুষ আছে, তাঁদের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশের বসবাস এ অঞ্চলে।
গত বছর ইউরোপে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। সেই তুলনায় এশিয়া অঞ্চলে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার কম, মাত্র ৩ শতাংশ। উত্তর আমেরিকার মতো এত বেশি হারে অতিধনী না বাড়লেও গত বছর ইউরোপ বিশ্বের অতিধনীদের বসবাসের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
সারা বিশ্বে ধনীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ধনীদের মধ্যে আবার অতিধনীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার হার বেশি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে যত মিলিয়নিয়ার বা ১০ লাখ ডলার বা এর চেয়ে বেশি মূল্যের ধনসম্পদের মালিক আছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ হলেন অতিধনী। কিন্তু বিশ্বের ধনীদের মোট সম্পদের ৩২ শতাংশই হচ্ছে ওই শ্রেণি তথা ১ শতাংশের হাতে।
বিশ্বে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা ৩ হাজার ১৯৪ এবং ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক ৭ হাজার ১৯৮ জন। সবচেয়ে বেশি ধনী রয়েছেন ৩ কোটি থেকে ১০ কোটি ডলারের শ্রেণিতে। এই শ্রেণির ধনীর সংখ্যা ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬০।
ধনী মানুষদের হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকায় সমাজের সব ক্ষেত্রেই, অর্থাৎ রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবা—সর্বত্রই তাঁদের প্রভূত প্রভাব আছে। ব্যক্তিগত বিলাসদ্রব্য কেনাকাটায় তাঁরা বছরে ১১৮ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। এ খাতে মোট যত ব্যয় হয়, তার ৩০ শতাংশই তাঁরা করে থাকেন। দানধ্যানের দিক থেকেও তাঁরা একেবারে পিছিয়ে নেই। এই অতিধনীরা জনহিতকর কাজের জন্য ১৯০ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার কোটি ডলার দান করেন। অর্থাৎ সারা বিশ্বে মানুষ যত দানধ্যান করেন, তার ৩৮ শতাংশই করেন এই ধনী মানুষেরা।
সম্প্রতি অক্সফামের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সঙ্গে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের ব্যবধান আরও বেড়েছে। গত এক দশকে এই ১ শতাংশ ধনী আরও ৪২ ট্রিলিয়ন বা ৪২ লাখ কোটি ডলার সম্পদের মালিক হয়েছেন।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত এক দশকে বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর প্রত্যেকের সম্পদ প্রায় ৪ লাখ ডলার করে বেড়েছে। একই সময়ে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছে গড়ে মাত্র ৩৩৫ ডলার। অর্থাৎ গড়ে তাঁদের সম্পদ বেড়েছে দৈনিক ৯ সেন্ট।
আলট্রাটার শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী, যাঁদের সম্পদমূল্য ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ ডলার, তাঁরাই হলেন ধনী। যাঁদের সম্পদমূল্য ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ থেকে ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ডলারের বেশি, তাঁরা অতিধনী।
এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) দাভোস সম্মেলনের সময় আরেক প্রতিবেদনে অক্সফাম বলেছিল, বিশ্বের অতিধনীদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ছেই। ২০২০ সালের পর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধনীর সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৮৬৯ বিলিয়ন বা ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে উঠেছে। ঠিক একই সময়ে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ আগের চেয়ে আরও গরিব হয়েছে।