উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হয়

বক্তারা বলেন, অমর্ত্য সেনের দৃষ্টিতে উন্নয়ন হচ্ছে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। বিভিন্ন বিকল্প থেকে একটা বেছে নেওয়ার সক্ষমতা।

মূল্যস্ফীতি
প্রতীকী ছবি

মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ হলে সামষ্টিক অর্থনীতির তেমন কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় সীমিত আয়ের মানুষের। সে জন্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে সমাজের সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার জাল বড় করতে হয়, তা না হলে এসব মানুষের জীবন কষ্টকর হয়ে ওঠে।

বাঙলার পাঠশালার পক্ষ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত প্রথম অমর্ত্য সেন লোকবক্তৃতায় এসব কথা বলেন ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতার পরিচালক অচিন চক্রবর্তী। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির হার ৯০ শতাংশে উঠলে আবার বিপদ। কারণ, সবাইকে তো আর সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তখন সেটা সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয় হয়ে ওঠে।

মূলত অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তা নিয়ে আলোচনা করেন অচিন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে যত আলোচনা হয়, তাঁর দার্শনিক চিন্তা নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। ১৯৯৮ সালে নোবেল কমিটি অমর্ত্য সেনকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল, সামাজিক চয়ন (সোশ্যাল চয়েস) ও ন্যায্যতার ধারণা নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বিশেষ করে সামাজিক চয়নের ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

অমর্ত্য সেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর অন্যতম হচ্ছে, উন্নয়নকে মানব স্ব–ক্ষমতা (ফ্রিডম) বা সক্ষমতার (ক্যাপাবিলিটিস) প্রসার হিসেবে দেখা। তিনি উন্নয়নকে নিছক বস্তু বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে সীমিত করেননি। স্ব–ক্ষমতা বলতে তিনি মনে করেন, অনেক বিকল্পের মধ্যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা। আর সক্ষমতা বলতে তিনি বোঝান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের মতো নানা বিষয়ের সমন্বয়। অর্থাৎ উন্নয়ন বলতে তিনি ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের কথা বলেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ। তিনি বলেন, এখন সমাজে যে ধরনের নিষ্ঠুরতা ও হানাহানি দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে বেরোতে তরুণদের অমর্ত্য সেন পাঠ করা জরুরি। এ ছাড়া তিনি অমর্ত্য সেনের জীবন ও কর্মের ওপর নানা দিক থেকে আলোকপাত করেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খানের। কিন্তু তিনি শেষপর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন না।

সভাপতির বক্তব্যে হেলাল উদ্দিন বলেন, একসময় ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বাজারের অবাধ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। এরপর জেন মেইনার্ড কেইনস বললেন, সরকারের ভূমিকা লাগবে। দেখা গেল, ১৯৩০-এর দশকে যখন মহামন্দা হলো, তখন কেইনসের তত্ত্ব জরুরি হয়ে উঠল। এরপর ২০০৭-০৮ সালেও কেইনসের প্রয়োজন হলো। বিষয়টি হলো সামাজিক পরিকল্পনাকারী প্রয়োজন।

কিন্তু সমস্যা হলো, বাজার অর্থনীতির সব সিদ্ধান্ত যে অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থের কারণে যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত হয় না। তখন মানুষ ভাবে, সরকার কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু সরকার কখনোই বলে না, তার কায়েমি স্বার্থের কারণে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অনুষ্ঠানে সক্ষমতা নিয়ে দর্শক সারি থেকে একজন প্রশ্ন করেন, সক্ষমতা বাড়লে মানুষ হয়তো অনেক কিছু মেনে নেবে না। ফলে সরকার কি সব সময় চায় মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাক।

এ প্রসঙ্গে হেলাল উদ্দিন বলেন, সামাজিক চয়নের তাত্ত্বিক কেনেথ অ্যারো উপপাদ্য করে দেখিয়েছেন, মানুষের ব্যক্তিক সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সামষ্টিক পর্যায়ে অনূদিত হয় না। সে জন্যই অমর্ত্য সেন তুলনামূলক ভালোর কথা বলেন। যাতে বিদ্যমান অবস্থা থেকে আরেকটু ভালো অবস্থায় মানুষ যেতে পারে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন।