কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে: অর্থনীতিবিদদের মত
বাজেটে ১৫ শতাংশ করের বিনিময়ে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। এই সিদ্ধান্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সেই সঙ্গে অর্থনীতিতে এখন স্থিতিশীলতা দরকার। তা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও সমস্যা হতো না।
আজ সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ আয়োজিত জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামাল, ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফেরদৌসী নাহার, রুমানা হক, সায়মা হক ও সৈয়দ নাইমুল ওয়াদুদ।
মাসুদা ইয়াসমিন বলেন, ‘অর্থনীতি একধরনের সংকটে আছে। এই পরিস্থিতিতে যে বাজেট দেওয়া হলো, তাতে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’
জাতীয় বাজেট পর্যালোচনা সভা সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, যাঁরা সৎভাবে আয় করবেন, তাঁরা ৩০ শতাংশ বা বেশি হারে কর দেবেন। অন্যদিকে ১৫ শতাংশ করের বিনিময়ে কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হবে, এটা ন্যায়সংগত নয়। তাঁর আশা, বাজেট আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হবে এবং সেটি বিবেচনায় নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামাল বলেন, ‘দক্ষতার অভাবে বিভিন্ন খাতে অপচয় বাড়ছে। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও আমরা তার সুফল পাই না। অদক্ষ জনগোষ্ঠী বিদেশে পাঠিয়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির আশা করা যায় না। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে আমাদের কৃষি উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তা না হলে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা আছে।’
এ ছাড়া বাজেট পর্যালোচনা সভায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করেন বক্তারা।
লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত ছিল
প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সে জন্য মুদ্রানীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে সংকোচনমূলক বাজেট করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, এ ধরনের লক্ষ্যমাত্রা ইতিবাচক হলেও বাস্তবভিত্তিক নয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে গত দুই বছরে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুব একটা কাজে দেয়নি। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব ছিল। বর্তমান বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অর্থনীতিতে একধরনের অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে কিছুটা শান্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। এতে প্রবৃদ্ধি কম হলেও অসুবিধা ছিল না।
বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ক্রলিং পেগে ডলারের বিনিময় মূল্য স্থির না রেখে নড়াচড়া করতে দেওয়া উচিত, তা না হলে যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে না। সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষ করে বেশি ঝুঁকেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়বে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন সমস্যা আছে, এগুলো সমাধানে বড় ধরনের সংস্কার উদ্যোগ হাতে নিতে হবে।
সরকার বাজেটঘাটতি আরও কিছুটা কমাতে পারত বলে মনে করেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সায়মা হক। তিনি বলেন, বাজেট যেহেতু সংকোচনমূলক, সেহেতু বাজেটঘাটতি আরও কম রাখা উচিত ছিল। এখন ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেবে, সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে।
টিসিবির আওতা বাড়ানোর পরামর্শ
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক আলোচনা করেন। অধ্যাপক ফেরদৌসী নাহার বলেন, সরকার বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ও আওতা বাড়ানোর কথা বলেছে। এটি ইতিবাচক। তবে দেখা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশই যায় পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদের ভর্তুকিতে। গত সাত বছরে দরিদ্র মানুষের সুরক্ষায় বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি, বরং শহরাঞ্চলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে।
অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, সরকার যেখানে সংকোচনমূলক নীতি নিয়েছে, সেখানে বড় ধরনের বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন তাত্ত্বিকভাবে আশা করা যায় না। ফলে শ্রমবাজারে একধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এ বিষয়ে বাজেটে বিস্তারিত পথনকশা থাকা উচিত ছিল বলে তাঁর মত। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে এসএমই খাত বড় অবদান রাখতে পারে, সে জন্য এ খাতে বরাদ্দ ও প্রণোদনা বৃদ্ধির বিষয়টি সরকার ভাবতে পারে।
অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, প্রায়ই দেখা যায়, সরকার বাজেট বরাদ্দ দিলেও তা ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। টাকা ফেরত যায়। সে জন্য শুধু বরাদ্দ দিলে হবে না, এর উপযুক্ত ব্যবহার ও সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের নগরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুবই ভঙ্গুর, সে ক্ষেত্রে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
অধ্যাপক সৈয়দ নাইমুল ওয়াদুদ বলেন, বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দুদকের সক্ষমতা আরও বাড়ানো যেতে পারে।