বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসায়ীরা আস্থা পাচ্ছেন না 

সংলাপে ব্যবসায়ীরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন।

টিকে থাকার লড়াইয়ে এবার ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের উচ্চহার নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ব্যবসায়ীরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আস্থার ঘাটতিতেও রয়েছেন তাঁরা। ব্যবসায়ীদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করাসহ অন্য বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া। অথচ সুদের হার বেশি রেখে ব্যবসায়ীদের ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে, যে ব্যবসায়ীরা বর্তমানেও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে আছেন। আগামী মার্চ মাসের পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়বে বলেও ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করেন। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকারের পক্ষে ৫ শতাংশ চাকরি দেওয়া সম্ভব। আর বেসরকারি খাত অসুবিধায় থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না, আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না।

ঢাকার ইস্কাটনের বিজ মিলনায়তনে গতকাল শনিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সংলাপ-অর্থনৈতিক সংলাপ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। এতে বিশেষ বক্তা ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সিজিএসের চেয়ার মুনিরা খানের সভাপতিত্বে পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাদিক মাহবুব ইসলাম ও বর্তমান শিক্ষার্থী সুপ্রভা শোভা জামানকে দিয়ে সংলাপ শুরু হয়। তাঁরা কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। প্রথম বক্তা সাদিক মাহবুব ইসলাম বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার জায়গা থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য, ভবিষ্যৎকে সুন্দরভাবে গড়া। যেহেতু বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি গত ১৫ বছরে ভালো হয়নি। আর সুপ্রভা শোভা জামান বলছিলেন, ‘আমরা দেখেছি উন্নয়নের যে গল্প ১৫ বছরে প্রচার করা হয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছে তা যায়নি। আমরা চেয়েছি ভালোভাবে খেয়ে–পরে বাঁচতে। সে কারণেই আন্দোলনটা। কিন্তু আমরা দেখেছি একদিকে আছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, অন্যদিকে আছে বাজার সিন্ডিকেট।’ 

সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু শুরুতেই দেশের প্রায় সব খাতের পরিসংখ্যানকে ‘ভুল ও মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, দেশে বছরে ২৫ থেকে ২৭ লাখ কর্মক্ষম লোক চাকরিজীবনে প্রবেশের যোগ্য হন। কেউ হয়তো চাকরি করেন না। ফলে কমপক্ষে ২২ লাখ লোক চাকরিতে প্রবেশের যোগ্য, যার ৫ শতাংশ যেতে পারেন সরকারি চাকরিতে। বাকি সবাইকে যেতে হবে বেসরকারি চাকরিতে। বেসরকারি চাকরির ব্যবস্থা হবে কিন্তু বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু বিনিয়োগ যাঁরা করেন, তাঁরাই আজ সবচেয়ে নিগৃহীত। 

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিনিয়োগের জন্য প্রথমে দরকার হচ্ছে সামাজিক মূলধন। কিন্তু তার অভাব রয়েছে। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির হারও। একশ্রেণির মানুষ কষ্ট করে সম্পদ সৃষ্টি করছেন। আরেক শ্রেণি আছে সম্পদ অর্জন করছেন কোনো কাজ না করে, এই শ্রেণির লোকেরাই বলে আসছিলেন ‘শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার।’ 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বৃদ্ধির সমালোচনা করে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, এই একটা কাজ করতে গিয়ে ১০টা জায়গায় অসামঞ্জস্য তৈরি করা হচ্ছে। সঞ্চয় কমলে বিনিয়োগ আসবে না। অন্যদিকে আছে অবকাঠামো সমস্যা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ২০০ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে এখনো আট ঘণ্টা সময় লাগে। 

এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আগের গভর্নর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে গেছেন। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বৃদ্ধি একটা উপায়। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে না পারলে শুধু এ উপায় দিয়ে কিছু হবে না।’

মীর নাসির বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলছি যে গ্যাস পাচ্ছি না, বাড়তি দাম দিয়েও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। সুদের হারের ৯-৬ শতাংশের সঙ্গে একমত আছি। এত সুদ দিয়ে শিল্প-বাণিজ্য কীভাবে টিকে থাকবে জানি না।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘বর্তমান কারখানাই টিকছে না, নতুন কারখানা কীভাবে গড়ে উঠবে? এদিকে নীতি সুদহার বাড়ছেই। আবার খেলাপি ঋণের নীতিমালা কঠোর করা হয়েছে। আগামী মার্চ মাসের পর খেলাপি ঋণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে?’

ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব এবং জ্বালানিসংকট—এ দুটি সমস্যা ব্যবসায়ীদের শেষ করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এনবিআরের নীতি ও প্রশাসন আলাদা করার প্রয়োজনীয়তার কথা আগেই বলেছি। কাজ হয়নি।’

এস আলমদের জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে সন্দেহের মধ্যে রাখা হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আজ ব্যবসায়ী সমাজ আস্থা পাচ্ছে না। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই—ব্যবসায়ীদের কেউই স্বস্তিতে নেই। পোশাক খাতে ১৮ দফা দাবি এল, যে দাবির মধ্যে অনেক কিছুই আইনের মধ্যে পড়ে না। আইনের বাইরে থাকলে কি বাহবা দেব?’ 

মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আগের সরকারের বাজেট কেন এখনো চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর মতে, এটা সংশোধন হওয়া দরকার। তিনি বলেন, গম, সার, ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ—এসব পণ্য কে কতটুকু আমদানি করে, সবাই জানে। কৃষকের বাজার, টিসিবি এবং জেলা প্রশাসন দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমবে না।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আবু ইউসুফ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দরকার বলে মনে করেন। তাঁর প্রশ্ন, মূল্যস্ফীতি কমাবেন কোন তথ্যের ভিত্তিতে? মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন কত? বলা হলো ভ্যাটের যন্ত্র ২৪ হাজার বসানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ১১ হাজার। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অভাবে ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। দরকার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। 

অর্থনীতি বিভাগের আরেক শিক্ষক ও সহ–উপাচার্য সায়মা হক বিদিশা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্য ঠিক করে এগোতে হবে। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের (এসএমই) শিল্পে।

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ঋণ দেওয়াই হয়েছিল তা ফেরত না নেওয়ার জন্য। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে “ন্যাশনাল প্রাইস ডিসকভারি মেকানিজম” দরকার। বাংলাদেশ চেম্বারের সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে দিতে হতো বকশিশ, পরে হলো স্পিড মানি, তার পরে এল ঘুষ। এভাবে একটা জেনারেশনকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি।’ এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, এনবিআরের নীতি ও প্রশাসনকে আলাদা করতে প্রজ্ঞাপন পর্যন্ত জারি হয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা হয়নি। সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশির চেয়ারম্যান এম এস সেকিল চৌধুরী বলেন, অর্থ পাচারকারীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা করা হয়েছে। 

যা বললেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য 

চুরির ঘটনায়ও যদি মামলা করার প্রয়োজন পড়ত, কোনো থানা নিত না। চুরির মামলা নেওয়ার জন্য এলাকার নেতাদের অনুমতি নিতে হতো। দেশটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকল করে দেওয়া হয়েছিল।

দেবপ্রিয় বলেন, ‘আপনাদের কথা শুনে মনে হলো দেশে একটি স্বাভাবিক সরকার বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পর একটি আন্দোলনের মুখে সরকার এসেছে। এটা কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়, যার বয়স তিন মাসও হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা ছেদ হয়েছে, যে কারণে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। একটা ভিন্নতর পরিস্থিতিতে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, কারও আলোচনায় এই স্বীকৃতিটাও দেখা গেল না।’

আগের সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘জাতীয় আয়কে নিয়ে খেলাধুলা করা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির তথ্য বিকৃত করা হয়েছে, রপ্তানি আয়ের পার্থক্যের কারণে লেনদেনের ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি করা হয়েছে। আর বিকল করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে।’ দেবপ্রিয় বলেন, ‘সবাই সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না। ভূমিহীন কৃষকের কী হবে, পোশাককর্মীদের মজুরি কত হবে, এসব নিয়েও ভাবতে হবে। আর প্রতিমুহূর্তে সবার কাছ থেকে জবাবদিহি চাইতে হবে, নইলে হবে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন সুফল না এলেও সামনে হয়তো আসবে।’ 

দেবপ্রিয় বলেন, ‘তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে, তাকে তুলে নিতে হবে—এসব চলছে। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার অর্থনৈতিক তাৎপর্য আছে। কারও রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে তার অর্থনৈতিক অধিকার কমে যায়।’