মধ্যবিত্তের খরচ আরও বাড়বে
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতে মধ্যবিত্তরা বিপাকে পড়েছেন। প্রতিবার বাজেট এলেই দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়—খরচ বাড়ছে কত? কোথাও কি ছাড় মিলবে? এবারের বাজেট থেকে ছাড়ের তুলনায় মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বেশি বাড়বে।
বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, মোবাইল ফোন, টিস্যু, ন্যাপকিন, কলম, শ্যাম্পু-সাবান থেকে শুরু করে জমি-ফ্ল্যাট কেনা—এসবের খরচ বাড়বে। করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম কর দিতে বাধ্য হবেন বহু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে নতুন বাজেট মধ্যবিত্তের জীবনকে আরও বেশি খরুচে করে তুলবে।
সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য এই বাজেট খুব বেশি যৌক্তিক হয়েছে, তা বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, কলম কিনতে গেলেও খরচ বেড়ে যাবে। এতে বোঝা যায়, যাঁরা বাজেট করেন, তাঁরা খুব একটা ভেবেচিন্তে করেন না। আয় বাড়াতে হবে সত্য, তবে কলমের কর থেকে আর কত রাজস্ব আসবে? এ ছাড়া জনপ্রশাসনে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে, তবে বেসরকারি খাতের কর্মীদের আয় বৃদ্ধি কিংবা নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের বিষয়ে তেমন কিছু বলা নেই।
খরচ বাড়বে যেখানে
বাজারের তালিকায় পণ্য না বাড়লেও খরচ বাড়বে। এখন মধ্যবিত্তের ঘরে টিস্যু, পেপার টাওয়াল ব্যবহার অনেকটাই অনিবার্য হয়ে গেছে। এসব টিস্যু, পেপার টাওয়াল ইত্যাদির ওপর আড়াই শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। ফলে মাসের বাজার খরচ বাড়বে।
এখন ঘরে ঘরে প্লাস্টিকের থালা, বাটিসহ নানা ধরনের গৃহস্থালির সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। দামও তুলনামূলক কম। কিন্তু নতুন বাজেট আপনাকে আগের মতো দামে এসব পণ্য কিনতে দেবে না। কারণ, প্লাস্টিকের থালা, বাটিসহ গৃহস্থালির পণ্যে ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে। একই সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বাসনকোসন, রান্নাঘরের সামগ্রীতেও একই হারে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। মধ্যবিত্তরা পরিবারের তৈজসপত্র কেনার খরচ বাড়বে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় রান্নার গ্যাসের চাপ থাকে না। অনেকেই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন। কিন্তু সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে আগের চেয়ে খরচ বাড়তে পারে। কারণ, এই খাতে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী এবার শিশু-কিশোরসহ শিক্ষার্থীদের প্রতি আগের মতো সদয় থাকতে পারেননি। কলমের ওপর ১৫ শতাংশর ওপর ভ্যাট বসিয়েছেন। আবার শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশের দামও বাড়তে পারে। এখন শহর-গ্রাম নির্বিশেষে তরুণদের বাইসাইকেল চালাতে দেখা যায়।
শখ–আহ্লাদ বাদ দিতে হবে
রূপচর্চা, সাজসজ্জা—এসব মধ্যবিত্ত পরিবারের শখ–আহ্লাদের বিষয়। খারাপ খবর হলো শখ–আহ্লাদে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিদেশি সাবান, ফেসওয়াশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়েছে। ফলে বিদেশি সাবান-ফেসওয়াশ বাদ দিয়ে দেশি প্রসাধনেই মজতে হবে।
সানগ্লাস হলো তরুণ-তরুণীদের শখের বস্তু। বিদেশি সানগ্লাস হলে তো কথাই নেই। এখন থেকে দেশি-বিদেশি সানগ্লাসে শুল্ক-কর বেড়েছে। ফলে যেকোনো ধরনের সানগ্লাসের দাম বাড়বে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চশমার ফ্রেমের দামও বাড়বে।
অতিথি অ্যাপায়নে ধনী পরিবারের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও বাসমতী চাল কেনেন। কিন্তু বাসমতী চালের দাম বাড়বে। একইভাবে বিদেশি ফলমূল, কাজুবাদাম খাওয়ার শখও দমাতে হবে।
জমি-ফ্ল্যাটের স্বপ্নে বাধা
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব শহরের মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন থাকে। এখন আগের চেয়ে বেশি খরচ করে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। সব ধরনের জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। এমনকি কাঠাপ্রতি ন্যূনতম করও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকা ছাড়াও মধ্যবিত্তের এলাকা হিসেবে পরিচিত বাড্ডা, বিজয়নগর, ইস্কাটন, বিজয়নগর, শান্তিনগরসহ রাজধানীর অন্য এলাকায় জমির নিবন্ধন খরচ বেড়েছে। দেশের অন্য এলাকায় জমি বা ফ্ল্যাট কিনলেও করের পরিমাণ বেড়েছে।
ন্যূনতম করে চাপ বাড়বে
করযোগ্য আয় না থাকলেও ৩৮ ধরনের সেবা নিতে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে, এমন প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ প্রস্তাব পাস হলে সবচেয়ে বেশি ভুগবেন মধ্যবিত্তরা। মূল্যস্ফীতির চাপে যখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন অনেক মধ্যবিত্ত, তখন এই কর তাঁদের জীবনযাত্রাকে আরও বেশি চাপে ফেলবে। শুধু সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগকারী নয়, ছোটখাটো ব্যবসায়ী, স্বল্প আয়ের সরকারি কর্মকর্তা, ক্রেডিট কার্ডধারী, উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং গাড়ি প্রদানকারী, অনলাইনে পণ্য বিক্রেতা—এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর এমন করের খড়্গ এল।
ভ্রমণের শখ বাদ দিতে হবে
যানজট কিংবা দীর্ঘ পথের ভয়ে মধ্যবিত্তদের অনেকেই এখন আকাশপথে ভ্রমণ করেন। কিন্তু তাতে বাদ সেধেছেন অর্থমন্ত্রী। আকাশপথে ২০০ টাকা ভ্রমণ কর বসিয়েছেন। এ ছাড়া সব ধরনের ভ্রমণ কর বাড়ানো হয়েছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন গ্রামগঞ্জ থেকে প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকেরা। তাঁদের বিমান টিকিটের দাম বাড়বে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এসব বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তখন বাজেটে বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা একেবারে অযৌক্তিক। তবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা ও ভাতা সামান্য বৃদ্ধির মতো বিষয়ও আছে।