স্বাধীনতা আন্দোলনে মেধাশক্তি দিয়ে পথনির্দেশ দিয়েছেন আনিসুর রহমান, শোকসভায় বক্তাদের মন্তব্য

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁরা মেধাশক্তি দিয়ে পথনির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আনিসুর রহমান। পাকিস্তান আমলে যে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়, তারও অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শগত হাতিয়ারের জোগান দিয়েছেন আনিসুর রহমানের মতো মানুষেরা।

বিকল্প উন্নয়ন দার্শনিক, রবীন্দ্রসংগীত গবেষক ও শিল্পী, অর্থনীতিবিদ ও স্বাধীনতা উত্তর প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর মরদেহ আজ মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। সেখানে আয়োজিত শোকসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আনিসুর রহমানের ছাত্র ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে আনিসুর রহমানের নিজস্ব মত ছিল। তিনি গতানুগতিক চিন্তার বাইরে চিন্তা করতেন। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি তৎকালীন শাসকশ্রেণির ভেতরকার দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ দেখেছেন। এসব দেখে তিনি যখন বুঝতে পারেন, এই কমিশন কিছু করতে পারবে না, তখন তিনি সরে দাঁড়ান।

আনিসুর রহমান সম্পর্কে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বলেন, মাস্টার্স পরীক্ষার ভাইভায় আনিসুর রহমান পাঠ্যবই থেকে প্রশ্ন না করে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা, ক্ষুদ্র উৎপাদকদের সমস্যা নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেন। এসব ক্ষেত্রে কীভাবে আন্দোলন–সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়, সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথ কী হতে পারে—এসব প্রায়োগিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।

আনিসুর রহমান রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করতেন। তবে গতানুগতিক ধারায় নয়, ভিন্নভাবে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন তিনি। তাঁর স্বদেশভাবনা, সংস্কৃতিভাবনা ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে অনেকে বলেছেন; একই সঙ্গে চলচ্চিত্রের সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল বলে উল্লেখ করেন বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মানজারে হাসীন মুরাদ। তিনি বলেন, হঠাৎ হঠাৎ দেখা যেত, তিনি পাবলিক লাইব্রেরি বা অন্য কোনো জায়গায় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতে টিকিটি কেটে নিঃশব্দে ঢুকে পড়তেন। চুপচাপ বসে ছবি দেখে চলে যেতেন। কখনো কখনো দু-একটি কথা বলতেন।

আনিসুর রহমানের মতো মানুষেরা চলে যাচ্ছেন। এ ধরনের মানুষের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র হওয়া দরকার বলে মনে করেন মানজারে হাসীন মুরাদ। চলচ্চিত্রকার শবনম ফেরদৌসি তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন—নাম ‘ভুবন ভরা সুর’। এই ছবিতে আনিসুর রহমানকে তাঁর আপন আলোয় দেখা যাবে।

বক্তারা বলেন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা সম্পর্কে নিজের দৃঢ় মত ছিল আনিসুর রহমানের। তিনি মনে করতেন, ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে এই আন্দোলন করা যাবে না, বরং নিচ থেকে আন্দোলন গড়ে উঠতে হবে বলে তিনি মনে করতেন।

আনিসুর রহমান ছাত্রদের নিয়ে গ্রামে কাজ করেছেন। এমনকি ছাত্রদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ধান চাষের উদ্যোগও নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন এম এম আকাশ। বলেন, তখন ডাকসুর নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই কাজে অগ্রণী হয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে আনিসুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ, বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আহমেদ জাভেদ প্রমুখ।

অনুষ্ঠান শেষ হয় আনিসুর রহমানের প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত তব ‘কণ্ঠে দিব মালা, দিব চরণে ফুলডালা’—এই গানের মধ্য দিয়ে। এই গানটি পরিবেশন করেন নাশিদ কামাল।

আগামীকাল বুধবার আনিসুর রহমানের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তাঁকে সমাহিত করা হবে। গত রোববার দুপুরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন।

১৯৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণাপত্র তৈরিতে সহায়তা করেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকও ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আনিসুর রহমান।