চীনের চারগুণ আর ভারতের বেড়েছে দ্বিগুণ

বিনিয়োগগ্রাফিক্স: প্রথম আলো

বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ এক অর্থবছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে চীন ও ভারতের বিনিয়োগ বেশ বেড়েছে। সর্বশেষ গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে চীন থেকে বিনিয়োগ আগের অর্থবছরের চেয়ে চার গুণ এবং ভারতের বিনিয়োগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অবশ্য তাতেও সামগ্রিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। গত তিন অর্থবছরের মধ্যে ২০২৩–২৪ অর্থবছরেই সবচেয়ে কম বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছর দেশে ১৪৭ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এই বিনিয়োগ ২০২২–২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। ২০২২–২৩ অর্থবছরে ১৬১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। ২০২১–২২ অর্থবছরে এসেছিল ১৭২ কোটি ডলার। এদিকে গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারে।

গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগে চমক দেখিয়েছে চীন ও ভারত। বিদায়ী অর্থবছরে চীনা বিনিয়োগকারীরা ২৮ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। এর আগের অর্থবছরে দেশটি থেকে বিনিয়োগ এসেছিল মাত্র ৬ কোটি ৮১ লাখ ডলারের। অর্থাৎ বাংলাদেশে গত অর্থবছরে চীনা বিনিয়োগ বেড়েছে ৪ গুণ বা ৩১৬ শতাংশ। যদিও গত তিন অর্থবছরের মধ্যে ২০২১–২২ অর্থবছরে চীন থেকে সবচেয়ে বেশি—৪২ কোটি ৮১ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল।

অন্যদিকে গত দুই অর্থবছর ধরে ভারত থেকে বিনিয়োগ আসা বাড়ছে। গত অর্থবছরে দেশটি থেকে ১৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। এই বিনিয়োগ তার আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বা ৮৯ শতাংশ বেশি। গত ২০২১–২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল।

চীন ও ভারত ছাড়াও বিদায়ী অর্থবছর নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, জাপান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে বিনিয়োগ বেড়েছে। এর মধ্যে নরওয়ে থেকে ৯ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। এর আগের বছর দেশটি থেকে বিনিয়োগ এসেছিল মাত্র ১ কোটি ডলারের। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর থেকেও গত অর্থবছর ৯ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। তার আগের বছর এসেছিল ৫ কোটি ডলার।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যুক্তরাজ্যের। বিদায়ী অর্থবছরেও দেশটি থেকে সবচেয়ে বেশি—৫০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। যদিও এই বিনিয়োগ তার আগের অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা কম। গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে ৫০ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বিনিয়োগ কমেছে। গত অর্থবছর দেশটি থেকে ৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। তার আগের বছর এসেছিল ১৫ কোটি ডলারের। আর ২০২১–২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে ৪৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল। তার মানে, গত তিন অর্থবছরের মধ্যে গতবারই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক ও বস্ত্র খাতেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে। যদিও গত অর্থবছর খাতটিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসা ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে পোশাক ও বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৪৪ কোটি ডলারের। এরপরে ব্যাংক খাতে ২৩ কোটি, রাসায়নিক ও ওষুধে ১২ কোটি, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামে ১২ কোটি, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ কোটি, কৃষি ও মৎস্য আহরণে ৬ কোটি এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এর মধ্যে রাসায়নিক ও ওষুধ এবং কৃষি ও মৎস্য আহরণ ছাড়া বাকি সব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আগের অর্থবছরের চেয়ে কমেছে।

ভিয়েতনামে ইতিমধ্যে অনেক চীনা বিনিয়োগ গেছে। ফলে সেখানে সুযোগ কমে আসছে। ভূরাজনৈতিক কারণে ভারতে চীনা বিনিয়োগ বেশি যাবে না। তাই সব মিলিয়ে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ানোর ভালো সুযোগ রয়েছে
এম এ রাজ্জাক, চেয়ারম্যান, র‌্যাপিড

সামগ্রিকভাবে এফডিআই কমে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগ (ইকুইটি) ও পুনর্বিনিয়োগও কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরে মোট ১৪৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ৬৭ কোটি ডলার হচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। নতুন বিনিয়োগ আসার হার গত দুই অর্থবছর ধরেই কমছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে ৬১ কোটি ডলারের পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে। তার আগের অর্থবছর ৭৯ কোটি ডলারের পুনর্বিনিয়োগ হয়েছিল।

বাংলাদেশে ব্যবসা করা দেশি–বিদেশি ব্যবসায়ীদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে যারা এ দেশে ব্যবসা করছে, তারা যদি সমস্যার মধ্যে থাকে, তাহলে বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যায়। সামগ্রিকভাবে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করা গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথও মসৃণ হবে।

গত মাসে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে দেশে ব্যবসা–বাণিজ্যে মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। চলতি বছরও প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতিসহ অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, উচ্চ করহার, নীতি পরিবর্তনসহ ব্যবসা–বাণিজ্যে ১৭টি চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন থেকে বিনিয়োগ সরছে। ভিয়েতনামে ইতিমধ্যে অনেক চীনা বিনিয়োগ গেছে। ফলে সেখানে সুযোগ কমে আসছে। ভূরাজনৈতিক কারণে ভারতে চীনা বিনিয়োগ বেশি যাবে না। এমনকি ভারত সরকারও খুব বেশি আগ্রহ দেখাবে না। তাই সব মিলিয়ে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ানোর ভালো সুযোগ রয়েছে।

এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘চার–পাঁচটি কাজ গুরুত্বসহকারে করলে আগামী দু–তিন বছরে বিদেশি বিনিয়োগ আসা বাড়বে। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর কমতে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, গ্যাস–বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাদ দিয়ে ১–২টি দ্রুত ঠিকঠাক করে বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিতে হবে যে আমরা প্রস্তুত। এ ছাড়া ব্যবসা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং ওয়ান–স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে।