কর বাড়ানোর উদ্যোগে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা

তৈরি পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, নন-এসি হোটেল, মিষ্টিসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ভ্যাট বাড়তে পারে।

করপ্রতীকী ছবি

হঠাৎ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য।

তবে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা সেই ছাড়টা দেখবেন।’

আগে একসময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। সেটি কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার পর ভ্যাট আদায় বেড়েছিল। কারণ, ভ্যাট কম হলে মানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
মাধব চন্দ্র ঘোষ, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মিষ্টি উৎপাদক সমিতি

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে হঠাৎ ভ্যাট, সম্পূরক শুল্কসহ বিভিন্ন ধরনের কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারই অংশ হিসেবে তৈরি পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে।

মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে গত বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশোধিত খসড়া অধ্যাদেশের অনুমোদনের বিষয়টি বৈঠক শেষে জানানো হলেও ভ্যাটের বিষয়ে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।

বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সেই লোকসান কাটিয়ে ওঠা যায়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ব্যবসা-বাণিজ্য ওলট-পালট করে দেওয়ার মতো এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে কেবল এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন

সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় মাধ্যম হচ্ছে ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে। এর বাইরে এখনো লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতার আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যকর উদ্যোগ কম। এমনকি ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে পারেনি সংস্থাটি।

এদিকে রাজস্ব আদায়ে অর্থবছরের শুরু থেকে ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। তখন চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয় আইএমএফ। এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সেই শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া এ মুহূর্তে সরকারের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবে সেটি কঠিন হওয়ায় ভ্যাট হার বাড়ানোর মতো সহজ পথে হেঁটেছে সরকার। পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে ভ্যাট বাড়ালেও মানুষের কষ্ট তুলনামূলক কম হতো।

ব্যবসায়ীরা যে কারণে ক্ষুব্ধ

রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খাবারের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এত দিন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বা এসি রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হতো। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট হোটেল ও রেস্তোরাঁ ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি। গত তিন বছরে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। যদিও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রেস্তোরাঁ মালিকেরা উদ্বিগ্ন। এক ধাক্কায় ভ্যাট তিন গুণ বাড়ানো হলে ব্যবসায় ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। ভ্যাটের সঙ্গে আয়করও বেড়ে যাবে। যাঁরা সব নিয়মকানুন মেনে ব্যবসা করেন, তাঁদের ওপরই সব সময় জুলুম হয়। আসলে আইএমএফের পরামর্শে ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর পাঁয়তারা চলছে। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে সমিতির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।

রেস্তোরাঁর পাশাপাশি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাটের হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। এর ফলে পোশাক কেনার খরচও বাড়বে। এ ছাড়া মিষ্টি কিনতে গেলেও খরচ বাড়তে পারে ভোক্তার। কারণ, মিষ্টি কেনায় ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে ফ্যাশন হাউস উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই-আগস্টে বড় লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। সেটি এখনো কাটিয়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। অস্থির এই সময়ে ভ্যাট হার বাড়লে মানুষ কেনাকাটায় আগ্রহ হারাবে। তিনি আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ভ্যাটের হার বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে পারে এনবিআর।

বাংলাদেশ মিষ্টি উৎপাদক সমিতির সাবেক সভাপতি মাধব চন্দ্র ঘোষ বলেন, এমন বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। আগে একসময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। সেটি কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার পর ভ্যাট আদায় বেড়েছিল। কারণ, ভ্যাট কম হলে মানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

রেস্তোরাঁ, পোশাক, হোটেল ছাড়াও অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বেড়ে যেতে পারে। কারণ, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন প্রস্তাব অনুসারে, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসতে পারে। এ ছাড়া মদের বিলের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যবসায় উৎপাদন ও পরিচালনার ব্যয় বাড়াবে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যে প্রতিফলিত হয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করবে। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করবে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আর্থসামাজিক প্রভাবগুলো গভীরভাবে মূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট খাতের অংশীজনদের সঙ্গে যথাযথ পরামর্শের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।