মাছ-মাংস খাওয়া কমেছে, ভাত খাওয়া বেড়েছে

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চার দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের একটি অধিবেশনে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। আজ ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলেছবি: প্রথম আলো

উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে গ্রাম এলাকার মানুষের খাদ্যের ধরনে পরিবর্তন হয়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষেরা মাছ-মাংসের মতো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছেন। এর বিপরীতে তাঁরা ভাতের মতো শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়েছেন।

গ্রাম এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিয়ে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিআইডিএসের বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আজ রোববার বিকেলে একটি অধিবেশনে এসব তথ্য তুলে ধরেন বিআইডিএসের গবেষকেরা।

রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত শিল্পশ্রমিকদের জীবনযাত্রার অবস্থা, মূল্যস্ফীতি ও সুস্থতাবিষয়ক এই অধিবেশনে আলোচনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, গবেষণা ফেলো মো. হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া, মো. জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী ও গবেষণা সহযোগী রিজওয়ানা ইসলাম। অধিবেশনটিতে সভাপতিত্ব করেন কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মইনুল আহসান।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গ্রাম এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তখন জিনিসপত্রের দাম বেশি থাকলেও তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে।

সেই প্রসঙ্গ টেনে বিনায়ক সেন বলেন, ‘ওই সময়ে একটা দাবি ছিল যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে। কিন্তু আমরা দেশের ৬৪ জেলায় জরিপ করে পেয়েছি, তখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশের বেশি ছিল। এর প্রধান ভুক্তভোগী গ্রাম এলাকার দরিদ্র মানুষেরা। তাঁরা মাছ-মাংসসহ প্রয়োজনীয় প্রোটিন খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছেন।’

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা খাদ্যের ধরন পাল্টেছেন। তাঁরা এখন আলু, পেঁয়াজ, সবজি, সয়াবিন তেল ও চিনি কম খাচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত ধনীদের মাছ-মাংস ও ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার কমিয়ে শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়েছেন।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত বছরের অক্টোবর–ডিসেম্বর তিন মাসে দেশের ৬৪টি জেলার ৬৪টি গ্রামের ৩ হাজার ৮৮৭টি পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে বিআইডিএস। জরিপে মোট ১১ ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০২২ সালের অক্টোবর–ডিসেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে ২০২৩ সালের একই সময়ে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

বিআইডিএসের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২২–এর তুলনায় ২০২৩ সালে, অর্থাৎ এক বছরে চালে ১-৫ শতাংশ, গরুর মাংসে ৬ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগিতে ১৫ শতাংশ, মাছে ২৭ শতাংশ, ফার্মের মুরগির ডিমে ২৪-২৭ শতাংশ, চিনিতে ৩৫ শতাংশ, তরল দুধে ২৫ শতাংশ ও সবজিতে ৩০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে।

মাথাপিছু ভোগ কমেছে

গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কীভাবে খাদ্য গ্রহণের ধরনকে প্রভাবিত করেছে, তা নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা সহযোগী রিজওয়ানা ইসলাম। তিনি জানান, ঐতিহাসিকভাবে দেশে ৫-৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। গত ২-৩ বছরে সেটি বেড়ে ৯-১০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করে। গ্রাম এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি অবশ্য আরও বেশি ছিল, ১৫ শতাংশের ওপরে।

রিজওয়ানা ইসলাম বলেন, উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রাম এলাকার দরিদ্র মানুষেরা তাঁদের খাদ্যের ধরন পাল্টেছেন। তাঁরা মাছ-মাংসের মতো অধিকাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ কমিয়েছেন। যেমন আগে গ্রামের অনেকে রুই-কাতলার মতো মাছ খেলেও এখন তাঁরা তেলাপিয়া ও পাঙাশের মতো কম দামের মাছ কিনছেন। আবার গরু বা খাসির মাংস খাওয়া কমিয়ে ফার্মের মুরগি ও ডিম খাওয়া বাড়িয়েছেন। তবে এ সময় মাছ-মাংস খাওয়া কমলেও বেড়েছে ভাত খাওয়ার পরিমাণ।

বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে গ্রামের মানুষ দৈনিক মাথাপিছু ৩৪৯ গ্রাম ভাত গ্রহণ করলেও তা পরের বছর বেড়ে ৩৯৪ গ্রাম হয়েছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে যেখানে দৈনিক মাথাপিছু ১০ গ্রাম গরুর মাংস খেতেন, সেখানে গত বছর তা কমে ৪ গ্রামে নেমেছে। এই সময়ে মাথাপিছু দৈনিক ফল খাওয়ার পরিমাণ ৯১ গ্রাম থেকে কমে ২৬ গ্রাম হয়েছে।

এভাবে গ্রামের মানুষের আলু, পেঁয়াজ, সবজি, সয়াবিন তেল, চিনি ও গরুর দুধের মতো বেশ কিছু খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামের দরিদ্র মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমলেও অপেক্ষাকৃত ধনীদের মাছ-মাংস ও ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।

রিজওয়ানা ইসলাম আরও বলেন, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গ্রামের মানুষের ভোগের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। এসব মানুষ পরিশ্রম করছেন বেশি, কিন্তু সে অনুযায়ী প্রোটিন খাবার খেতে পারছেন না। এতে তাঁদের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

শিল্পশ্রমিকদের দারিদ্র্য বেশি

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে উৎপাদন খাতে নিয়োজিত শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেন বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো মো. হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া। তিনি জানান, শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার এখন ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ; এই হার জাতীয় পর্যায়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা গেছে, উৎপাদন খাতে (শিল্প) নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সর্বনিম্ন ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ সর্বোচ্চ দারিদ্র্য হিসাব করলে জাতীয় পর্যায়ের কিংবা শহরের দারিদ্রের চেয়েও শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি।

বিআইডিএসের তথ্যমতে, উৎপাদন খাতে নিয়োজিত একজন শ্রমিকের ৪ সদস্যের পরিবারের জন্য মাসে ন্যূনতম ব্যয় হয় ২২ হাজার ৯৭৯ টাকা। এই খাতের শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে ১৯ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ২৩ হাজার ৯০০ টাকা মজুরি দাবি করে আসছেন। হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া জানান, উৎপাদন খাতের প্রায় ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ শ্রমিক তাঁদের পরিবারের ব্যয়ের চেয়ে কম আয় করছেন।

হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, উৎপাদন খাতে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের চেয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা কম মজুরি পান। তবে যেসব শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত রয়েছেন, তাঁদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বেশি। এ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত রয়েছেন, এমন নারী শ্রমিকেরা কর্মস্থলের পাশাপাশি নিজ পরিবারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশি গুরুত্ব পান।