চাপে থাকবে মানুষ, স্বস্তি কেবল কালোটাকার মালিকদের

দীর্ঘ সময় ধরে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। মূল্যস্ফীতি তো আছেই, বাজেটে বেড়েছে করের বোঝা। এ নিয়ে শুরু নতুন অর্থবছর। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন ৬ মাস পরে সংকট কাটবে। মানুষ কতটা ভরসা রাখবে, সে প্রশ্ন তো আছেই।

মূল্যস্ফীতিপ্রতীকী ছবি

দেশে অর্থনীতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিযোগিতা আছে। যেমন বাজেট বড় দেখাতে হবে; পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের অর্থবছরের তুলনায় বেশি হতে হবে; টাকাকে কৃত্রিমভাবে হলেও শক্তিশালী রাখতে হবে এবং জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগের লক্ষ্য বেশি দেখাতে হবে। অর্থনীতিতে জোরজবরদস্তি চলে না। আর তা করা হলে ফল কি হয়, তা ভালোভাবেই টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। সংকট থেকে বের হতে পারছে দেশ।

দুই বছর ধরে আরেকটি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। আর তা হচ্ছে তিন মাস পরপর বলা যে আগামী তিন মাসের মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এভাবে কত তিন মাস যে গেল, কিন্তু সমস্যার সমাধান আর হচ্ছে না। নতুন অর্থমন্ত্রী অবশ্য আরেকটু বেশি সময় নিয়েছেন, তিনি ছয় মাসের কথা বলেছেন। আজ থেকে নতুন অর্থবছরের শুরু। সুতরাং সমস্যার সমাধান তাহলে ডিসেম্বরের পরে!

কত বেশি কর দিতে হবে

নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবার বাজেটের আকার আট লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি এনে রেখে দিয়েছেন। সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কর বাড়াতে হবে ১৭ দশমিক ০৭ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে সব মিলিয়ে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬৩ হাজার কোটি টাকার কর বেশি দিতে হবে। এর মধ্যে আয়কর বেশি দিতে হবে ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা আর ভ্যাট বেশি দিতে হবে ২৪ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালে বাজেট বক্তৃতায় ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই-এর উক্তি ব্যবহার করে বলেছিলেন, ‘রাজহাঁস থেকে পালক ওঠাও যতটা সম্ভব ততটা, তবে সাবধান, রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়।’

করের যে বোঝা, মূল্যস্ফীতির যে চাপ, তাতে দেশের সাধারণ মানুষ এবার ব্যথা পাবেই। তবে অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৬ মাস পরে ব্যথা কমবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।

যেখানে স্বস্তি নেই

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। তবে ১৯৮১ সালে যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তখন মার্কিন অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভয়াবহ বিপদে। সেই পরিস্থিতি থেকে সারা বিশ্ব উচ্চ মূল্যস্ফীতির অধ্যায় থেকে বের হতে পেরেছিল তাঁর সময়েই। তাঁর চেয়ে ভালো কে জানেন যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কতটা খারাপ। তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ংকর এবং খুনির মতোই প্রাণঘাতী।’

রোনাল্ড রিগ্যানের সেই কথার অর্থ এখন খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে দেশের মানুষ। ১৫ মাস ধরে এখানে মূল্যস্ফীতির ৯ শতাংশের বেশি। অথচ মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাজেটে আর কিছু পায়নি দেশের মানুষ। এবারের বাজেটে আয়করের দিক থেকেও সাধারণ মানুষকে কোনো স্বস্তি দেওয়া হয়নি। আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হলেই আয়কর দিতে হবে। আর বরাবরের মতোই সরকারের ভরসা পরোক্ষ করের ওপরেই। অর্থাৎ ভ্যাট, ভ্যাট আর ভ্যাট।

দেশের মানুষের মনের কথা এখন একটাই। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করে সিনেমার পর্দায় অভিনেতা আনোয়ার হোসেন যেমনটা বলেছিলেন, ‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে দেবে আশা কে দেবে ভরসা!’ অর্থমন্ত্রী অন্তত সেই ভরসা বাজেটে খুব একটা দিতে পারেননি।

টাকার হরেক রকম রং

শুরুতে টাকার রং একটাই। পরে এর রং বদলায়। মালিকের যে রং, টাকারও তখন সেই রং হয়। অর্থাৎ সাদাটাকা কালো হয়ে যায়। আবার অনেকে বলেন, কালোটাকাও রং বদলাতে পারে। কালোটাকা দিয়ে যদি জমি কেনা হয়, তাহলে সেই টাকার রং হয় সবুজ। যেমন সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ জমি কিনেই কালোটাকা সাদা করার চেষ্টা করেছিলেন। আবার কালোটাকায় যদি বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা হয়, তখন সেই টাকার রং হয় বাদামি। রিয়েল এস্টেটের প্রতীকী রং বাদামি ধরা হয়। এখানেও নাম আসবে বেনজীর আহমেদ ও এনবিআর কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান বা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের। একইভাবে কালোটাকা দিয়ে সোনা কিনলে সেই টাকার রং হয়ে যায় হলুদ। এখানে নাম আসবে কলকাতায় নিহত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ও তাঁর খুনিদের।

দেশে এখনো অনেক বেনজীর আছেন। বড় বড় আমলাদের দুর্নীতির খবর বের হচ্ছে। সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় কেউ যদি সামান্য ভয় পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের জন্য নতুন বাজেটে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সিকিউরিটিজ, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের আমানত, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, জমি—সবই এখন সাদা করা যাবে মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে। বাজেটে বলা হয়েছে, ‘দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক, এই বিধান কার্যকর হবে এবং কোনো কর্তৃপক্ষই কোনো প্রকারের প্রশ্ন করতে পারবে না।’

প্রশ্ন হচ্ছে, এতে কালোটাকার মালিকেরা কি আশ্বস্ত হলেন? তাঁরা কি কালোটাকা সাদা করবেন? যদি না করেন, তাহলেও কিন্তু সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, অর্থ পাচারের সব সুবিধাই বহাল আছে। পাচার রোধে দেশে কঠোর কোনো নজরদারিও নেই। নেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও। সবই আছে কাগজে-কলমে। যেমন অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় পাচার করা অর্থ উদ্ধার নিয়ে একটা গাইড লাইন তৈরির কথা বলেছেন বটে, সেটিও পুরোনো। এর বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে কালোটাকার মালিকেরা ভরসা পেতেই পারেন।

জীবন পুষ্পশয্যা নয়

ধরুন, আপনি আপনার পছন্দের মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। যদি মুঠোফোনে দিনক্ষণ ঠিক করতে কথা বলেন, আগের চেয়ে বেশি খরচ হবে। কারণ, বাজেটে মুঠোফোনের কল ও ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আগের তুলনায় ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আবার দেখা করার সময় দেশি ফুল নিলেই ভালো। কেননা, বিদেশি ফুলের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কোথাও বসে যদি আইসক্রিম, জুস বা কোমল পানীয় খেতে চান, সেখানেও বাড়তি খরচ। বিদেশি কোনো ফল খেতে চাইলেও আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। এবার করের হাত থেকে আমসত্ত্বও রেহাই পায়নি।

অবশ্য দেখা করতে যাওয়ার সময়ে নারী-পুরুষনির্বিশেষে বিদেশি ব্লেজার বা জ্যাকেট, টি-শার্টসহ প্রায় সব ধরনের পোশাক পরলে খরচ একটু কম পড়বে। এসব পণ্যের কর কমেছে। ব্যক্তিগত ব্যবহার্য পোশাকেরও কর কমানো হয়েছে।

বিপত্তি আরও আছে। কথাবার্তা সব ঠিকঠাক থাকলে যদি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন, সেই বিয়ে যদি কোনো কমিউনিটি সেন্টারে হয়, তাহলে আয়কর পরিশোধের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। এমনকি এখন তো ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে কোথাও বেড়াতে গেলেও খরচ বাড়তে পারে। তাঁদের এখন থেকে কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ হারে, আগে যা ছিল শূন্য।

আবার নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি সার্ভিসের কাছে গেলেও বাড়বে করের বোঝা। শুল্ক বাড়ানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার ওপরেও। এমনকি কর বসেছে লটারি টিকিট বিক্রেতার ওপরেও।

সুতরাং সত্যি সত্যিই জীবন পুষ্পশয্যা নয়। আর যেখানে এবার পুষ্প বা ফুলের ওপর কর বসানো হয়েছে, তাতে তো এটা বলাই যায়।

ভালো খবরও আছে

একটি বাজেটে সব যেমন খারাপ হয় না, ভালো অনেক কিছুই থাকে। যেমন নতুন বাজেটে বলা হয়েছে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শারীরিক প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য র৵াম্প করে না দেবে, তাদের আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে। এ ছাড়া বাজেটে ধান, চাল, গমসহ নানা নিত্যপণ্যের সরবরাহে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। তবে যেহেতু সরকারের বাজার নজরদারি ব্যবস্থা দুর্বল, সে কারণে এর সুফল হয়তো ভোক্তারা সহজে পাবেন না।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটু আশার আলো দেখানো হয়েছে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইনফরমেশন টেকনোলজি এনাবেলড সার্ভিসের (আইটিইএস) জন্য করছাড় থাকবে ২০২৭-এর ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে এ জন্য সব অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হতে হবে। এই খাতগুলো হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, ব্লক চেইননির্ভর সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার অ্যাজ সার্ভিস ও ডেটা সায়েন্স।

সবচেয়ে ভালো খবরটি সব শেষেই দেওয়া যাক। বিশেষ করে যাঁরা বড় কিছু উৎপাদন করার কথা ভাবেন, তাঁদের জন্য অবশ্যই এটি সুখবর। এবারের বাজেটে স্থানীয়ভাবে কম্পিউটার এক্সেসরিজ ও আইটি পণ্য উৎপাদনে করছাড় দেওয়া হয়েছে। এমনকি যদি উড়োজাহাজ বানাতে ইচ্ছা করে, তাহলেও করছাড় দেওয়া হবে। কেননা, উড়োজাহাজ বা এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন এবং এর যন্ত্রাংশ আমদানি করতে কর লাগবে না।

২০০৫ সালে হংকংয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকের জন্য শুল্কছাড় দেওয়া হয়নি। অথচ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে তা পাওয়ার কথা ছিল। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে দেশে ফিরে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ব্যাঙের পা থেকে অ্যারোপ্লেন পর্যন্ত আমরা শূন্য শুল্কে পাঠাতে পারব।’ এত দিনে সেই কথা সত্য প্রমাণের সুযোগ এল।