হঠাৎ ভারতীয় ঋণ ছাড় থমকে গেছে
দেশে ভারতীয় ঋণের ছাড় কমে গেছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র সাড়ে চার কোটি ডলার ছাড় করেছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক, যা দেশীয় মুদ্রায় মাত্র ৫৪০ কোটি টাকার মতো।
মূলত গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র–জনতার আন্দোলন–অভ্যুত্থানের সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ হয়নি বললেই চলে। ভারতীয় ঋণে পরিচালিত একটি প্রকল্পের ঠিকাদার ও কর্মরত জনবল তখন নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁদের দেশে চলে যান। এ ছাড়া একাধিক প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ গভীর ছিল। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে শেখ হাসিনা নিজে সে দেশে চলে যান। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতের এক্সিম ব্যাংক লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) দিয়েছে। এসব কারণে ভারতীয় ঋণ ছাড়ে প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন।
ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি ডলারের মতো ছাড় করে আসছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র তারা ৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার ছাড় করেছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শুধু ভারতীয় ঋণের প্রকল্পই নয়; অন্য সব প্রকল্পের বাস্তবায়নও কম হয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের ফলে দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। আবার এর প্রভাব ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে পড়েছে, তা–ও ধরে নেওয়া যায় না। ভারতীয় পক্ষ যেমন প্রকল্প বাদ দেয়নি, তেমনি সরকারও বলেনি যে প্রকল্প আর করব না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরেকটু সময় লাগবে।
জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর ভারতীয় ঋণের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় এলওসির মাধ্যমে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প। এ কাজের জন্য ২০১৮ সালে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ৫ আগষ্টের পর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিরাপত্তাজনিত কারণে কাজ ফেলে রেখে নিজেদের দেশে ফিরে গেছেন। গত সপ্তাহে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর তাঁরা কাজে ফিরে আসতে রাজি হয়েছেন। প্রায় চার মাস এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
প্রতিশ্রুতি ৭৩৬ কোটি ডলারের, ছাড় ১৮৪ কোটি
ভারতের সঙ্গে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের প্রথম ঋণচুক্তি হয়, যা প্রথম লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত। ওই এলওসির অর্থের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ২০০ কোটি ডলার ও ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসি তথা ঋণচুক্তি হয়। তিন এলওসি মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে, গত দুই যুগে প্রতিশ্রুতি অনুসারে অর্থ ছাড় হয়নি। গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৮৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম এলওসির ৭৭ কোটি, দ্বিতীয় এলওসির ৫২ কোটি ও তৃতীয় এলওসির ৫৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত প্রথম এলওসির ৩৭ কোটি ডলারের মতো পরিশোধ করা হয়েছে। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এই ঋণ দিচ্ছে।
তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি শেষ হয়েছে। চলমান আছে আটটি প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ কিংবা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।
কোন বছর কত এল
গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বশেষ তিন বছরে ৩০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেছে ভারত। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের এক্সিম ব্যাংক ৩১ কোটি ১৪ লাখ ডলার ছাড় করেছে। এর আগের দুই অর্থবছরে যথাক্রমে ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ও ৩২ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ছাড় হয়েছে।
কোভিডের প্রথম দুই অর্থবছরে ঋণ ছাড় বেশ কম ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪ কোটি ১১ লাখ ডলার দিয়েছে ভারত, যা এর আগের বছরে ছিল ১৪ কোটি ৮ লাখ ডলার।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, শিগগিরই দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে। সেখানে দ্রুত অর্থ ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা হবে।