চার ধরনের ঝড় ও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশের অর্থনীতি

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাজেট প্রস্তাব নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, দেশে এখন একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মোট আয়ের ৬০ শতাংশই খাবারের পেছনে খরচ করতে হয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বাজেট প্রস্তাববিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ। গতকাল সোমবার ঢাকার ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, দেশের অর্থনীতিতে এখন চার ধরনের ঝড় ও ঝুঁকি আছে। এগুলো হচ্ছে বহির্বিশ্বের সমস্যা থেকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে; সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো এখন ব্যক্তিপর্যায়ে চলে এসেছে; বাজারপ্রক্রিয়া আরও দুর্বলতর হচ্ছে, বড় ব্যবসায়ীরা ছোটদের খেয়ে ফেলছে, বড়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করে অর্থনীতির এই সংকট থেকে উত্তরণ হবে না, আরও বাড়তি উদ্যোগ লাগবে।

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ঢাকা শহরে চারজনের একটি পরিবারের প্রতি মাসে খাবার কিনতে খরচ হয় ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। মাছ-মাংস না খেলে এই খরচ কমে ৭ হাজার ১৩১ টাকায় নেমে আসে। এই হিসাব ফেব্রুয়ারি মাসের। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবারের ফেব্রুয়ারিতে পরিবারপ্রতি খাবার খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

সিপিডি জানায়, মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল, মরিচ, হলুদ, আদা, রসুনসহ ১৭টি নিত্যপণ্যের প্রতিদিনের বাজারদর এবং একজন মানুষ গড়ে কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে, তার ভিত্তিতে খাবার খরচের হিসাবটি করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা শহরে চারজনের পরিবারের প্রতি মাসে খাবার কিনতে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার ১১৫ টাকা। মাছ-মাংস না খেলে এই খরচ ছিল ৫ হাজার ৬৮৮ টাকা।

ঢাকার ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে গতকাল সোমবার এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। সে জন্য দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি খাতে ৫ শতাংশ বেতন বাড়ানো উচিত। সব খাতের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোয় জোর দিয়ে তিনি বলেন, পারলে এই ঈদেই বেতন–ভাতা বাড়ানো যেতে পারে।

এ ছাড়া আগামী বাজেটে করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে ন্যূনতম করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।

কয়েক মাস ধরেই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এখন চাল, ডাল, তেলের পাশাপাশি মাছ-মাংস, ডিমের দাম বেশ চড়া। সর্বশেষ বাজারদর অনুযায়ী প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০-২৩০ টাকা ও গরুর মাংস ৭৫০-৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা। মাছ-মাংসের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের খাবারের পাত থেকে মাছ-মাংস উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য, রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবণতা, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি, ব্যাংকে তারল্য ও ডলার–সংকট, আর্থিক খাতে ভারসাম্যহীনতা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস—এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে সুশাসন এবং শৃঙ্খলা আনতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনলে কোনো প্রশ্ন করবে না সরকার—এ সুযোগ আগামী বাজেটে বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, এ ধরনের সুযোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, যা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগও বন্ধ করা দরকার।

সিপিডি ব্যক্তিগত পর্যায়ের করদাতাদের করহার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশে উন্নীত করা ও বিনিয়োগ করে কর রেয়াত পাওয়ার আগের সুবিধা বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া অ্যাডহক ভিত্তিতে দেওয়া সব ধরনের কর প্রণোদনা আগামী অর্থবছর থেকে প্রত্যাহারের চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

তামাকজাত পণ্যের ওপর আরও শুল্ক-কর বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে সিপিডি। বলেছে, স্বাস্থ্যের ক্ষতি বিবেচনায় এক লিটার বোতলজাত কোমল পানীয়র ওপর ১০০ টাকা হারে নির্দিষ্ট শুল্ক বসানো উচিত। স্যানিটারি ন্যাপকিন ও এ–জাতীয় পণ্যের ওপর সব ধরনের শুল্ক-কর প্রত্যাহার করা উচিত।

এ ছাড়া সিপিডি মনে করে, চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।

ব্যাংক খাতের সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে সিপিডি। বলেছে, ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ, ব্যাংকগুলোর নিজেদের লোকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ, অভ্যন্তরীণ নজরদারি—এসব বিষয়ে ভালো নীতি বা নিয়ম থাকলেও তা পরিপালিত হয় না। তাই তিন মাসের জন্য ব্যাংক কমিশন করে এই খাতের সার্বিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করে সিপিডি বলেছে, একাধিক হার হওয়ার কারণে এই খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।

এ ছাড়া ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের চাপে ফেলার সমালোচনা করেছে সিপিডি। বলেছে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রতি মাসে একবার পর্যালোচনা করা উচিত। বিপিসি এখন লাভের মধ্যে আছে। বাজারভিত্তিক দর হলে এখন জ্বালানি তেলের দাম কমানো যেত। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ প্রথা বাতিল করে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে’ ব্যবস্থায় যাওয়া দরকার।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বাজেটের মাধ্যমে যত প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা আবারও পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছে।