অপরিকল্পিত ঋণের বিশাল দায়, ভারসাম্য নেই সরকারি আয় ও ব্যয়ে
তিন মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
সরকারি আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য নেই। রাজস্ব আহরণ ও সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণেই এমন হয়েছে। এতে আর্থিক শৃঙ্খলা যেমন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তেমনি বছরজুড়ে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে হয়, যার জন্য বড় অঙ্কের সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এসব কথা জানিয়ে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের উদ্দেশে চিঠি পাঠিয়েছে। অর্থ বিভাগ চিঠিতে সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে বাজেট বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
অর্থ বিভাগ বলেছে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রতি মাসে বাজেট বরাদ্দ থেকে নিজেদের বেতন-ভাতাটা ঠিকমতো নিচ্ছে। কিন্তু তারা বাজেটে ঘোষিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন, রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যয় এবং বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ গ্রহণ—এসব পরিকল্পনা তৈরির কাজটা যথাযথভাবে করছে না।
অর্থ বিভাগ চিঠিতে বলেছে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ থাকছে, তা থেকে প্রতি মাসে নিজেদের বেতন-ভাতাটা তারা ঠিকমতো নিচ্ছে। কিন্তু তারা বাজেটে ঘোষিত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা, ব্যয় পরিকল্পনা এবং বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা তৈরির কাজটা যথাযথভাবে করছে না।
প্রতিবারের মতো চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও কিছু কার্যক্রম ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ও সময়নিষ্ঠ পরিকল্পনা দরকার। আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের বাজেট বাস্তবায়ন অর্থবছরের প্রথমার্ধে ধীরগতিতে চলে। শুরুর দিকে রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রেও চলে ধীরগতি।
অর্থ বিভাগের চিঠির বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতারও খুব মিল পাওয়া যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুসারে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংস্থাটি আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
জানা গেছে, এনবিআর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই–সেপ্টেম্বর) কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্ষাকালে কাজ খুব একটা হয় না। এ সময়ে রাজস্ব আদায়ও কম হয়। এবার অবশ্য জুলাইয়ে আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
চিঠিতে অর্থ বিভাগ বলেছে, ইউটিলিটি বা পরিষেবার বিল দেওয়া, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ করা, মালামাল কেনা—এসব কাজে সবাই পদক্ষেপ নেয় বছরের শেষ দিকে। এতে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান বজায় রাখা হচ্ছে না। ফলে বছর শেষে সরকারকে অপরিকল্পিত ঋণের দায়ভার নিতে হচ্ছে। অর্থ বিভাগ বলেছে, বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ সমানভাবে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। আর প্রতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে আগের মাসের সব ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে হবে।
অর্থ বিভাগ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিক থেকেই মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে জোর দিয়েছে। সেই সঙ্গে বলেছে, পরের ত্রৈমাসিকগুলোতে এমনভাবে টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে, যাতে ভালোভাবে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা যায় এবং শেষ ত্রৈমাসিকে মাত্রাতিরিক্ত বিল পরিশোধের চাপ সৃষ্টি না হয়। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় পণ্য–সেবা কেনার জন্যও যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে চিঠিতে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা যাচাইয়ে সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন দাখিলের তাগিদ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন পাঠাতে হবে বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটিতে। এ কমিটি অনুমোদন করলে প্রতিটি প্রান্তিক শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন যাবে অর্থ বিভাগে।
সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব সংগ্রহ এবং ব্যয়ের গতিধারা তিন মাস পরপর পর্যালোচনা করার কথা। পর্যালোচনার ফলাফল ও করণীয়–সম্পর্কিত প্রতিবেদন সংসদের পরের অধিবেশনে উপস্থাপনের কথা অর্থমন্ত্রীর। এখন যেহেতু সংসদ নেই, সেহেতু এ দায়িত্ব অর্থ বিভাগ নিজেই নিয়েছে।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, প্রথম প্রান্তিকের পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন পাঠানোর শেষ দিন ছিল গত রোববার; কিন্তু সেদিন পর্যন্ত অনেক মন্ত্রণালয় ও দপ্তর প্রতিবেদন পাঠায়নি।