‘ভাত–কাপড়’ ছাপিয়ে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনোদনে

গ্রাফিক্স: আমিনুল

‘ভাত-কাপড়’ ছাপিয়ে বিনোদনেই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। চাল, ডাল, শাকসবজি, দুধ-ডিম, মাছ-মাংস, জামাকাপড়-এসব কেনার খরচ যতটা বেড়েছে, এর চেয়ে ঢের বেশি হারে বেড়েছে নাটক-সিনেমা, খেলা দেখার খরচ। নেটফ্লিক্সের মতো বিনোদন মাধ্যমেও খরচ বেড়েছে। দাম বেড়েছে বিনোদন পার্কের টিকিটেরও।

সহজ করে বললে, দৈনন্দিন জীবনে বিনোদন ও সংস্কৃতির জন্য আপনাকে আগের চেয়ে আরও বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নভেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।

মূল্যস্ফীতি গণনায় এখন জাতিসংঘের ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অব ইন্ডিভিজ্যুয়াল কনজাম্পশন অ্যাকোর্ডিং পারপাস’ বা কইকপ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সেখানে খাবার, পোশাক, আবাসন, যাতায়াত, পরিষেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ ১২টি খাতের মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়। গত নভেম্বর মাসে এই ১২ খাতের মধ্যে ‘বিনোদন ও সংস্কৃতি’ খাতে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

এর মানে হলো, বিনোদন ও সংস্কৃতিতে অর্থাৎ নাটক, সিনেমা, খেলা, কনসার্ট দেখা, ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আপনি যদি ২০২২ সালে নভেম্বর মাসে ১০০ টাকা খরচ করতেন, এ বছরের নভেম্বর মাসে এ খাতে আপনার খরচ বেড়ে ১১৫ টাকা ৯৩ হয়েছে। পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১৫ টাকা ৯৩ পয়সা। বিবিএস সূত্র বলছে, জীবনযাত্রার খরচে বিনোদন ও সংস্কৃতি খাতের অবদান অবশ্য ১০ শতাংশের কম।

তবে বিবিএসের হিসাবে, একজন মানুষ ভোগের পেছনে যত টাকা খরচ করে, তার প্রায় এক–চতুর্থাংশ খরচ হয় চাল কেনায়। আর চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের পেছনে খরচ হয় প্রায় অর্ধেক। বাকি খরচ হয় খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, যাতায়াত, পরিষেবা, বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য পণ্যের পেছনে।

বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনার পর বিনোদন ও সংস্কৃতি খাতের কর্মকাণ্ড অনেক বেড়েছে। বিনোদন জগতে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আরও বিস্তৃত হয়েছে। বিনোদন পার্কগুলোও সচল হয়েছে। আবার খাবার, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, শিক্ষার খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে বিনোদন জগতে। তাই সেখানে খরচ বেড়েছে।

একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—এক-দুই বছর আগে রাজধানীর আশপাশের মোটামুটি মানের বিনোদন পার্ক বা রিসোর্টগুলোতে একদিনের জন্য খাবার ও অন্যান্য বিনোদনের জন্য জনপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকার প্যাকেজ ছিল। এখন তা বেড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা হয়েছে। ফলে ভোক্তাকে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি শোভন জীবনযাপনের জন্য বিনোদনের দরকার আছে। খাবারের দাম বেশ বেড়েছে। এখন বিনোদনের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। তবে এর ফলে মানুষ বিনোদনে খরচ কমাবে, যা একটি শোভন জীবনের জন্য অন্তরায়।’

নভেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির খাতওয়ারি চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১২টি খাতের মধ্যে বিনোদনসহ চারটি খাতের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। অন্য তিনটি হলো, খাদ্যে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ; আবাসন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পরিষেবায় ১০ দশমিক ১৮; বাসাবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। এসব খাতেই সাধারণ মানুষের খরচ বেড়েছে, জীবনযাপনে অনেকের কষ্টও বেড়েছে। এ ছাড়া পোশাকে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং পরিবহনে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপ নিতে হচ্ছে মানুষকে।

৯ মাসে ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি

জিনিসপত্রের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায়। অর্থনীতির ভাষায় তা মূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, টানা ৯ মাসে ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে।

এটি বেশ উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল। পরের মাসে তা ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে উঠে যায়। এরপর আর তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থেকেই কখনো সামান্য কমেছে, কখনোবা একটু বেড়েছে। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

আশঙ্কার বিষয় হলো, গত আগস্ট মাসের পর থেকে টানা তিন মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে ছিল। নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে, তবে তা এখনো ১০ শতাংশের ওপরেই আছে।
এ বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০-১২ শতাংশের মধ্যে আছে। এটি বেশ উদ্বেগজনক। খাবারের দাম বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকেন।’
তাল মেলাতে পারছে না মজুরি

পণ্য মূল্যের তুলনায় আয় বেশি বাড়লে বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনতে সমস্যা হয় না। কিন্তু দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তার চেয়ে মজুরি বেড়েছে কম হারে। যেমন গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর আর মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতিকে ধরতে পারেনি। সর্বশেষ মাস অর্থাৎ নভেম্বরে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। এর মানে হলো, মজুরি যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম।

গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর ভিত্তি করে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হারের হিসাব করে থাকে বিবিএস। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি মতো। তাদের প্রায় সিংহভাগই মজুরিনির্ভর। এই শ্রেণির মানুষের ওপরই মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ছে।