২০ শতাংশ অদরিদ্র পরিবার দরিদ্র হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে

দারিদ্র্য নিরসনে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমানে প্রায় দেশে প্রতি পাঁচটি অদরিদ্র (নন–পুওর) পরিবারের মধ্যে একটি, অর্থাৎ ২০ শতাংশ পরিবার এখন দরিদ্র হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। আর উচ্চ ঝুঁকিতে না থাকলেও প্রায় অর্ধেক অদরিদ্র বা নন–পুওর পরিবারের পুনরায় দরিদ্র্য পরিস্থিতিতে (ভালনারেবল) পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের প্রথম দিনের একটি অধিবেশনে এমন তথ্য জানান বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে দারিদ্র্যবিষয়ক এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে খানাভিত্তিক দারিদ্র্য ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেন বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরি। তিনি জানান, সাধারণ মানুষের জন্য বিভিন্ন মৌলিক পরিষেবা সহজলভ্য হওয়ায় তা দারিদ্র্য পরিস্থিতি কমাতে বড় অবদান রেখেছে। তা সত্ত্বেও জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের পর অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ নানা কারণে এমন ঝুঁকি বেড়েছে।

যেসব কারণে দেশে দারিদ্র্যের ঝুঁকি বাড়ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বন্যা, অতিবৃষ্টি, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য তুলে ধরে সার্জিও অলিভিয়েরি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত মোকাবিলায় অধিকাংশ দরিদ্র পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খরচ করে। এসব মানুষের হার ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে দুর্যোগের ধাক্কা মোকাবিলায় ৩১ শতাংশ দরিদ্র পরিবার তাদের খাওয়ার খরচ কমিয়েছে। এ ছাড়া সাড়ে ৬ শতাংশ দরিদ্র পরিবার তাদের সম্পদ বিক্রি করে ও সাড়ে ১৬ শতাংশ দরিদ্র পরিবার ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। খুব কমসংখ্যক পরিবারই দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্যের আঘাত মোকবিলায় সরকারি সাহায্য পেয়েছে। এই হার মাত্র ৪ শতাংশ, যারা সরকারি সহায়তা পেয়েছে।

বর্তমান খাদ্যমূল্যের অস্থিরতাকে দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন সার্জিও অলিভিয়েরি। তিনি বলেন, আয় কম বা আয় নেই, এমন পরিবারের সদস্যরা বেশি কষ্টে রয়েছেন। এ সমস্যার টেকসই সমাধানে তাঁদের আয় বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য মানসম্মত শিক্ষায় বিনিয়োগ, সরবরাহ খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

‘স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার’

অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক আউটলুক তথা পূর্বাভাসের তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ধ্রুব শর্মা বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে সাধারণ মানুষ ভোগের পরিমাণ কমিয়েছেন। অন্যদিকে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটেছে, রপ্তানি চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে বিনিয়োগ ও শিল্প উৎপাদন কমেছে। এসব কারণে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমবে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

ধ্রুব শর্মা বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় তিনটি ক্ষেত্রে সরকারি নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধি, বিনিময় হারের নমনীয়তা ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনা। ঋণের খরচ বাড়ায় সরকারি-বেসরকারি ক্রেডিট গ্রোথ, অর্থাৎ ঋণে প্রবৃদ্ধি কমেছে। তারপরও সরকার মুদ্রানীতির কঠোরতা থেকে সরছে না। তাতে মনে হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলও দেখা গেছে বলে মন্তব্য করেন ধ্রুব শর্মা। তিনি বলেন, গত আগস্ট মাসের পর থেকে বিনিময় হার অনেক স্থিতিশীল রয়েছে। আনুষ্ঠানিক মাধ্যম তথা বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় আসার পরিমাণ বেড়েছে এবং রপ্তানির ধারাও ইতিবাচক। তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আশা করা যায়, চলতি অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

সরকার বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তৈরি করলেও সেগুলো সহজে পাওয়া যায় না এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নেথ্রা পালানিস্বামী। তিনি জানান, সরকার তথ্যের প্রবেশাধিকার ও ব্যবহারের চেয়ে শুধু তথ্য উৎপাদনের ওপর বেশি জোর দেয়। অন্যদিকে এসব তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি, মান ও তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

নেথ্রা পালানিস্বামী আরও বলেন, সরকার যে সূচক অনুসারে খাদ্যের দারিদ্র্যের সীমা হিসাব করে, তা ১৯৭০–এর দশকে তৈরি। বর্তমান সময়ের কনজাম্পশন বা ভোগের ধরনের আলোকে এটি হালনাগাদ করা প্রয়োজন।