নতুন আয়কর আইনে ক্ষমতা বাড়ল কমিশনারদের, কমল কর গোয়েন্দাদের
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন আয়কর আইন চালু করেছে এনবিআর। এখন থেকে আয়করসংক্রান্ত সব কার্যক্রম চলবে এই আইনের আওতায়।
নতুন আয়কর আইনে কর গোয়েন্দাদের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) মহাপরিচালক ও পরিচালক পদমর্যাদার নিচের কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফলে কর গোয়েন্দাদের কাজে পদে পদে অনুমোদন লাগবে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলের কর কমিশনারদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। তাঁরা এনবিআরের অনুমোদন ছাড়াই যেকোনো করদাতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন।
নতুন আয়কর আইনের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন আয়কর আইন চালু করেছে এনবিআর। এখন থেকে আয়করসংক্রান্ত সব কার্যক্রম চলবে এই আইনের আওতায়।
আইন অনুযায়ী এখন থেকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) মহাপরিচালক ও পরিচালক পদমর্যাদার নিচের কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে কর ফাঁকিসংক্রান্ত কোনো তদন্ত করতে পারবেন না। বলা প্রয়োজন, সিআইসির উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকেরাই মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকেন। আগের আয়কর অধ্যাদেশে তাঁদের এই ক্ষমতা ছিল।
নতুন আয়কর আইনের ২০৪ ধারায় বলা হয়েছে, তদন্তকারী আয়কর কর্তৃপক্ষ যেকোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কর ফাঁকির অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারবে। একই আইনের ১৯৮ ধারায় তদন্তকারী আয়কর কর্তৃপক্ষ হয়ে কারা করদাতার বিষয়ে অনুসন্ধানকারী হবেন, তা বলা হয়েছে। সেখানে সিআইসির মহাপরিচালককে শুধু এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো কর্মকর্তাকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
আবার নতুন আইনের ৪ নম্বর ধারায় আয়কর কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিআইসির মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিচালককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ধারায় তাঁদের কাজের পরিধি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। যেমন করদাতাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম; গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে সংগৃহীত তথ্যের সঙ্গে আয়করের রেকর্ড বিশ্লেষণ; কর পরিহার, গোপন করা আয় ও অনিয়ম শনাক্ত করা; ফাঁকি দেওয়া কর আদায়ে তাঁরা মামলা করতে পারবেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সিআইসিতে ২৬ জন কর্মকর্তা আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন মহাপরিচালক ও দুজন পরিচালক আছেন। এ ছাড়া ১৩ জন যুগ্ম পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক মর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া রাজস্ব কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও পরিদর্শক মিলিয়ে আছেন ১০ জন। ২৬ জন কর্মকর্তার মধ্যে ৩ জন কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে কর ফাঁকি ধরতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য ও সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আমিনুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে পরিবর্তনের ফলে ভালো ও খারাপ—দুই দিকই আছে। ভালো দিক হলো, ক্ষমতা যত নিচের দিকে নামবে, তত বেশি হয়রানির সুযোগ থাকে। পরিচালক পর্যন্ত ক্ষমতা থাকলে একধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। গোয়েন্দাদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা কমল। অন্যদিকে খারাপ দিক হলো, এতে দীর্ঘসূত্রতা বাড়বে। তদন্ত পরিচালনা করতে জটিলতা তৈরি হবে। উপকর কমিশনাররা কর ফাঁকির তথ্যপ্রমাণ পেলে মামলা করতে পারেন। তাঁরাই তো সিআইসিতে পদায়ন হয়ে উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক হন। তাহলে তাঁদের কেন এই ধরনের ক্ষমতা থাকবে না?’
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ২০০৪ সালে কর প্রশাসনের সংস্কারের অংশ হিসেবে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) এবং সিআইসি গঠিত হয়। এই রাজস্ব সংস্কারটি বেশ সফল হয়েছিল। এলটিইউর অধীন ১ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান করদাতার কাছ থেকে মোট কর আদায়ের ৩০-৩৫ ভাগ আসে।
অন্যদিকে বড় করদাতাদের কর ফাঁকি ধরতে উন্নত বিশ্বের আদলে বিশেষায়িত কর গোয়েন্দা ইউনিট হিসেবে সিআইসি গড়ে তোলা হয়েছিল। কর ফাঁকির পাশাপাশি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের দায়িত্বও ছিল সিআইসির ওপর। প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে বড় বড় কর ফাঁকি তদন্তে বেশ সক্রিয় ছিল সিআইসি।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, নতুন আইনে কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা কমানোর অংশ হিসেবে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে।
১/১১-এর সময়ে ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল
সিআইসি প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে কর ফাঁকি তদন্তে মহাপরিচালকের ক্ষমতা আয়কর অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলেও উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকদের আলাদা করে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এর ফলে বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের করা বহু মামলা উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে যায়।
তখন আদালতের যুক্তি ছিল, আয়কর আইনে ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও এসব কর ফাঁকির তদন্ত করেছেন সিআইসির উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকেরা। এমন অবস্থায় ২০০৯ সালে আয়কর অধ্যাদেশের সংশোধনী এনে ২৫ এএ ধারা যুক্ত করে তাঁদের কর ফাঁকি তদন্তে ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন আইনে সেই ক্ষমতা রাখা হয়নি।
ফৌজদারি মামলায় অনুমতি লাগবে না
নতুন আইনে কর অপরাধের জন্য ফৌজদারি মামলায় পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আগে কোনো করদাতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে এনবিআরের বোর্ড সভায় মামলার প্রস্তাব উপস্থাপন করে অনুমোদন নিতে হতো। এখন কর কমিশনারের অনুমোদনে মামলা করা যাবে।