বিবিএসের জরিপের তথ্য
দেশের এক–তৃতীয়াংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত
২০১৬ সালে পরিবারপ্রতি গড় ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকা। সেটি ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা।
দেশের মানুষের পরিবারপ্রতি ধার বা ঋণ করা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এক-তৃতীয়াংশ পরিবার ধার করে জীবন যাপন করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত বুধবার খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছে বিবিএস। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিবিএস মিলনায়তনে এ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির উপপরিচালক এবং খানার আয় ও ব্যয় জরিপ প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭ শতাংশ পরিবার গত এক বছরে হয় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নয়তো বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ বা ধার করেছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপকালে গড়ে ৩৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পরিবার ঋণ বা ধারের কথা জানিয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে ধার বা ঋণ করে চলা পরিবার ছিল গড়ে ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। সেই হিসাবে গত ৬ বছরে দেশে ধার করে চলা পরিবারের সোয়া ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি বেড়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। দেশে দেখা দেয় ডলার–সংকট। তাতে দেশেও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। তাতে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষকে বাধ্য হয়ে ঋণ করতে হয়। সেই চিত্র উঠে এসেছে বিবিএসের জরিপেও। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকেও দেখা যায়, গত বছর ক্রেডিট কার্ড থেকে মানুষের ধার করা বেড়েছে।
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এসে পরিবারপ্রতি ধার বা ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০২২ সাল শেষে পরিবারপ্রতি গড় ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা। ২০১৬ সালে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকা। বিবিএসের জরিপের তথ্য বলছে, গত বছর গ্রামের মানুষের চেয়ে শহরের মানুষই বেশি টাকা ধার করেছেন। ২০২২ সালে শহরাঞ্চলে পরিবারপ্রতি গড় ধারের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৫ টাকা। একই সময়ে গ্রামাঞ্চলে পরিবারপ্রতি এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯২১ টাকা।
মানুষের ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দ্রব্যমূল্য বা জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা তিন ধরনের পরিবার দেখতে পাই। একটি গোষ্ঠী সব সময় আয়ের-ব্যয়ের একটা ঘাটতিতে থাকে। দ্বিতীয় আরেকটা গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের আয় ব্যয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। আর তৃতীয় গোষ্ঠীটির ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি, এটিকে সারপ্লাস জনগোষ্ঠী বলা হয়। কিন্তু তিনটি গোষ্ঠীই ঋণগ্রস্ত থাকে। প্রথমটি আয়-ব্যয়ের সংস্থানের জন্য নিয়মিত ঋণ করে। দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি ঋণ করে মূলত দৈনন্দিন জীবনে হঠাৎ দেখা দেওয়া প্রয়োজন মেটাতে। আর সারপ্লাস জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ঋণ করে মূলত বাড়ি, গাড়ি কেনার জন্য। এ কারণে বিবিএসের জরিপে সামগ্রিকভাবে ঋণগ্রস্ত পরিবার ও ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।’
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে ঋণগ্রস্ত পরিবার বেশি। গ্রামাঞ্চলে গড়ে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত। আর শহরাঞ্চলে এ সংখ্যা গড়ে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ। তবে ২০১৬ সালের চেয়ে ২০২২ সালে এসে শহরাঞ্চলে ঋণগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা বেশি বেড়েছে। ২০১৬ সালে শহরাঞ্চলে গড়ে ঋণগ্রস্ত পরিবার ছিল ২২ দশমিক ১০ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলে সেই সংখ্যা ছিল ৩২ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০২২ সালে এসে শহরে ঋণগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট, গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অর্থনীতির অগ্রগতি ও আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা বা প্রবণতাও বেড়ে যায়। এটি বেশি ঘটে শহরাঞ্চলে। এ কারণে আমরা দেখছি, আর্থিক খাতে ভোক্তা ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে।’
গ্রামের চেয়ে শহুরে মানুষের বেশি ঋণ করার কারণ প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন, ‘স্বল্পোন্নত অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি। আবার আমাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয়ের বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে। আমরা উচ্চ ব্যয়ে নিম্নমানের জীবন যাপন করি। এ কারণে একশ্রেণির শহুরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ও পণ্যমূল্যের চাপ তো রয়েছেই।’