মাংস, ডিম ও দুধের উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে দামও
দেশে প্রতিবছরই ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ছে। তা সত্ত্বেও বাজারে অস্থিরতা রয়ে গেছে। উৎপাদনের সঙ্গে দামও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সাধারণত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বাড়লে বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দেশে সেটাই হচ্ছে। যেমন গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে চাহিদার তুলনায় ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন বেশি হয়েছে। তারপরও প্রাণিজ এসব আমিষের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
ডিম, দুধ ও মাংসের দাম বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া ও দেশে মূল্যস্ফীতির চাপকে দায়ী করা হয়। তবে দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির জন্য বাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকির অভাব এবং সরবরাহে অব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে সামনে এসেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। আর মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। এই ১০ অর্থবছরে দুধ উৎপাদন ৬১ লাখ টন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ টন। সব ধরনের মাংসের ক্ষেত্রে যা ৪৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৭ লাখ টন।
সরকারি সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে ডিম, দুধ ও মাংস—এই তিন প্রাণিজ আমিষের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই অর্থবছরে তিনটি পণ্যের দামে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়। যেমন ডিমের হালি ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৫০ টাকার ওপরে ওঠে, গরুর মাংস বিক্রি হয় ৭৫০–৮০০ টাকা কেজি এবং খাসির মাংস হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। দুধের দাম কয়েক দফা বেড়ে লিটারপ্রতি শতকের কাছাকাছি চলে যায়।
ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে ডিম-মুরগির দাম যৌক্তিক হারে সমন্বয় হতে হবে। তাহলে খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করবেন না। তাতে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। কোনো চক্র যাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে না পারে, তা দেখার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে বাজারে ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিমের হালি ছিল ৩৪ টাকা। তখন গরুর মাংস ৩০০ টাকা, খাসির মাংস ৪৯০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো। আর তরল দুধের দাম ছিল ৫৮ টাকা লিটার। বর্তমানে বাজারের ফার্মের মুরগির ডিমের হালি ৫৫-৬০ টাকা; গরুর মাংস ৮০০ টাকার আশপাশে, খাসির মাংস ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকার কাছাকাছি কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর দুধের লিটার ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ডিম ও মুরগির মতো আমিষের দাম বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়। তবে দাম কতটুকু বাড়ছে বা যৌক্তিক হারে সমন্বয় হচ্ছে কি না, তা–ও দেখার বিষয়। একই সঙ্গে সময়ে সময়ে কোনো একটি পণ্যের দাম হুট করে বাড়লে তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে সরবরাহের অব্যবস্থাপনা ও বাজারে তদারকির অভাবকেই দায়ী করছেন কেউ কেউ। অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর কথাও বলছেন অনেকে।
এ বিষয়ে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন ১৮০ টাকায় এক ডজন ডিম কিনতে হয়, তখন আমি বুঝে উঠতে পারি না সাধারণ মানুষ কীভাবে তাঁদের সংসার চালাচ্ছেন। বাজার পরিস্থিতি ঘরে-বাইরে সব জায়গায় অশান্তি তৈরি করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফা করার প্রবণতা থামাতে হবে। তবে এটাও ঠিক, পরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে ধরেবেঁধে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।’
দেশে গত বছরের আগস্ট থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। এই এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি দেখা গেছে। এর মানে হলো, দেশের মানুষকে এক বছর ধরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব। তা থেকেই অনুমেয়, গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি। সাধারণত উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহব্যবস্থা এবং আয় বৃদ্ধি—এসবের ওপর ভিত্তি করেই মূল্যস্ফীতি কমে। বর্তমান বাস্তবতায় শিগগিরই মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নেমে আসার মতো পরিস্থিতিতে নেই।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনমতে, দেশে প্রতিবছর ডিম, মাংস ও দুধ উৎপাদন বাড়ছে। আবার বাজারে এগুলোর দাম বেশ চড়াই থাকে। তাই প্রতিবেদনের তথ্যের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে কি না, জানতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এমদাদুল হক তালুকদারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে কল কেটে দেন।