বাজেটে ঋণের শর্ত মিলছে কি না, দেখবে আইএমএফ

২৫ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফের নতুন মিশন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের প্রায় তিন মাস পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের স্টাফ কনসালটেশন মিশন পাঠাচ্ছে ঢাকায়। মূলত বাজেট-সহায়তা হিসেবে দেওয়া অর্থের ব্যবহারের শর্ত পূরণের বিষয়ে আলোচনা করবে এ মিশন। সেই সঙ্গে ঋণ কর্মসূচিও থাকবে আলোচনায়। আগেরবারের মতো এ বৈঠকেও আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। দলটি হবে তিন থেকে চার সদস্যের। ঢাকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রগুলো জানায়, আইএমএফ মিশনটি ২৫ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। সংস্থাগুলো হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আইএমএফ গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পরই প্রথম কিস্তিতে ছাড় করেছে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে দেবে ঋণের পুরো অর্থ। সেই হিসাবে বাকি আছে আরও ছয় কিস্তি।

অর্থ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ সাধারণত প্রতি কিস্তি দেওয়ার আগে শর্ত পালনের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করে থাকে। সে অনুযায়ী দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে ঋণের শর্ত পূরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি দল আসবে আগামী সেপ্টেম্বরে।

সাধারণত প্রতিটি বাজেট ঘোষণার আগে বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। এখন যেহেতু তাদের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি চলছে, সেহেতু বাজেট-সহায়তার পাশাপাশি ঋণের শর্ত পূরণের বিষয়গুলোও আলোচনায় আসবে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই।

যোগাযোগ করলে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেট-সহায়তাসহ ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত যে সময়বদ্ধ শর্তগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আইএমএফের এবারের মিশনটি আলোচনা করবে। আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে কিছু শর্ত পূরণ হওয়ার কথা। সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে কী উদ্যোগ নিল, তা জানতে চাইতে পারে তারা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও এনবিআর ইতিমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেগুলো আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের স্টাফ কনসালটেশন মিশন আসার কথা জানিয়ে বিভিন্ন সংস্থার কাছে গত সপ্তাহে চিঠি পাঠিয়েছেন আইএমএফের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান (আবাসিক প্রতিনিধি) জয়েন্দু দে। চিঠিতে তিনি ঋণ কর্মসূচির বিপরীতে আইএমএফকে দেওয়া বাংলাদেশের শর্ত পূরণের হালনাগাদ চিত্র প্রস্তুত রাখতে দপ্তর প্রধানদের অনুরোধ করেছেন।

এদিকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জয়েন্দু দে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আইএমএফের ঋণ নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। শর্তগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক খাতের মধ্যে আবার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ব্যাংক খাত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে।

জানা গেছে, আইএমএফ মিশনটি বাংলাদেশে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু, আগামী জুনের মধ্যে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি ও ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রতিবছর ব্যাংকগুলোর খারাপ ঋণের তথ্য প্রকাশ, ব্যাংকের পুনঃতফসিল করা ঋণকে খেলাপি ঋণের হিসাবে আনা, বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলবে।

এবারের মিশন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, তাদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পুনর্মূলধন, খেলাপি ঋণের অবস্থা, তারল্য পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন সংশোধন এবং দেউলিয়া আইন প্রণয়নসহ পাঁচটি আইন প্রণয়নের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইবে।

বিশ্বের যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, বাংলাদেশ তার অন্যতম। ফলে এ দেশে প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। ঋণের শর্ত হিসেবে কর আদায়ের কৌশল ঠিক করতে বলেছে আইএমএফ। এ ব্যাপারে সংস্থাটি কারিগরি সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রথম পর্যালোচনার আগেই করতে হবে কাজটি। প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর এ বিষয়ে এনবিআর কী করল, তা সংস্থাটির কাছে জানতে চাইবে মিশন।

এনবিআরের জন্য একটি বড় শর্ত হলো, শুল্ক-কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানো। শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট চালু করাও আরেক শর্ত। এনবিআর সূত্রমতে, বর্তমানে বছরে এনবিআর গড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো কর অব্যাহতি দেয়। পর্যায়ক্রমে এই কর অব্যাহতি কমিয়ে সরকারের বিভিন্ন খাতে খরচ করার সামর্থ্য বৃদ্ধির পক্ষে আইএমএফ। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ তা শেষ করতে হবে।

জানতে চাইলে আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত প্রতিটি বাজেট ঘোষণার আগে বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। এখন যেহেতু তাদের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি চলছে, সেহেতু বাজেট-সহায়তার পাশাপাশি ঋণের শর্ত পূরণের বিষয়গুলোও আলোচনায় আসবে। তারা এবার দেখবে আগামী বাজেটটি ঋণ কর্মসূচির শর্তগুলোর সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ হচ্ছে। ফলে ছোট হলেও আইএমএফের এবারের মিশনটিও গুরুত্বপূর্ণ।