আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তিন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ও অপচয় কমিয়ে দক্ষতার সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য মধ্যমেয়াদি সংস্কার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
সিপিডি বলছে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। রাজস্ব আহরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে শ্লথগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট, রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এ মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ। এমন বাস্তবতায় তাই আগামী বাজেটে তিনটি বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
যেসব কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে, সে কারণগুলো আমলে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা না করে শুধু একীভূত করা হলে কার্যকর কিছু হবে নামোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলন এসব সুপারিশ তুলে ধরে সিপিডি। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষক মুনতাসীর কামাল প্রমুখ।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের চাপে রয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সংকটে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করাই নতুন বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি আগামী বাজেটে পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরক্ষাও নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন ফাহমিদা খাতুন। তাঁর মতে, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে, যাতে ব্যাংকঋণনির্ভরতা কমিয়ে রাজস্ব আয় দিয়েই সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া সরকারি ব্যয়ে অর্থের অপচয় কমানোর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। খরচের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা জরুরি।
সিপিডি বলছে, চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন টাকা বেশি না ছাপানো, ডলারের দাম বাজারের কাছাকাছি রাখা। তবে এসব উদ্যোগের পরও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর রয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি, রিজার্ভ, প্রবাসী আয়, বিদেশি বিনিয়োগসহ বেশির ভাগ সূচকেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ দাবি
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমানো ছিল বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তা বাস্তবায়নে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু কেউ বাজার প্রভাবিত করে ৭ দিনে ৫০ কোটি টাকা লাভ করতে পারলে ৫০ লাখ বা ১ কোটি টাকা জরিমানা করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। সে জন্য বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে এবং তা দৃশ্যমান হতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, সব ধরনের শিল্প খাতের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেন লাগামহীনভাবে না বাড়ে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রাজস্ব ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে
সিপিডি জানায়, ১০ থেকে ১১ বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই ঘাটতি থাকবে; বছর শেষে তা ৮২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
সরকারের বাজেট ঘাটতি কমেছে ঠিক, কিন্তু ঘাটতি নিরসনে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এতে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ কমে যেতে পারে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে কর্মচাঞ্চল্য থাকা প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যাচ্ছে না। সংস্কার কোথায় দরকার, তা বহুবার বলা হয়েছে। এখন বাজেটে তার প্রতিফলন রাখা দরকার।
ব্যাংকের একীভূত হওয়া ইতিবাচক
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার ঘটনা ইতিবাচক। ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ার পেছনে বাস্তব কারণ ছিল। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চতুর্থ প্রজন্মের এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের অভাব ছিল দৃশ্যমান। যেসব কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে, সে কারণগুলো আমলে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা না করে শুধু একীভূত করা হলে কার্যকর কিছু হবে না।
‘এডিপি পুরোটা ঋণনির্ভর’
বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় পুরোটাই ঋণনির্ভর বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। কাঠামোগতভাবে এটি বড় ধরনের সমস্যা। এই দুর্বলতা ভবিষ্যতে দেশকে বিপজ্জনক ও বাধ্যতামূলক ঋণনির্ভরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাজেট প্রস্তাবনায় বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। এ ছাড়া প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।
আরও যেসব প্রস্তাব এসেছে
আগামী বাজেটে পরিবেশ সম্মত জ্বালানি খাতের প্রকল্পে বরাদ্দ ও সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। এ ছাড়া আগামী অর্থবছর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসা এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও বৈদ্যুতিক গাড়ি খাতে কর অবকাশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সিপিডি। প্লাস্টিক দূষণ কমাতে উৎপাদনকারীদের ওপর প্লাস্টিক করারোপ ও প্লাস্টিক ব্যাগের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ডেন্টাল, প্রকৌশল ও কারিগরি কলেজের ১৫ শতাংশ করপোরেট আয়কর কমিয়ে ১০ শতাংশ করা; ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফি ভ্যাটমুক্ত করা ও আমদানি করা বইয়ের কর মওকুফের প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।