স্থিতিশীল হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি, কমে এসেছে মূল্যস্ফীতি

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। এতে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোভিড-১৯ সংকট কাটিয়ে উঠছিল, তখনই শুরু হয় এ যুদ্ধ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধির কৌশল অবলম্বন করে। তাতে ধারণা করা হচ্ছিল, ২০২৩ সালের শেষে বা ২০২৪ সালের শুরুতে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোতে মন্দা দেখা দিতে পারে।

শেষমেশ মন্দা হয়নি; বরং ২০২৪ সালে এসে বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। অনেক দেশের প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্‌-কোভিড পর্যায়ে ফেরেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস হচ্ছে, বিদায়ী ২০২৪ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে লড়াই শুরু হয়েছিল, সে লড়াইয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জয়ী হয়েছে। যদিও বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে এখনো মূল্যস্ফীতির হার বেশি।

আগামীকাল মঙ্গলবার শেষ হবে ২০২৪ সাল। এই বছরে বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির মতো বিষয় নির্বাচনের মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, যেমন শ্রীলঙ্কা। আবার ভারতের মতো দেশে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়াটা ক্ষমতাসীন বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

—২০২৫ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি ৬০ মার্কিন ডলারে নেমে যেতে পারে। —সরকারি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ৫৩% উন্নত দেশ ও ৬৪% উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের কারণে হতে পারে।

সেই সঙ্গে ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) মতো যুগান্তকারী প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। বছরের শেষ ভাগে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় আরোহনের আগেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্রতা পেতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদের।

ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যে ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বিশ্বের যেকোনো দেশের পণ্যেই তিনি ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র কানাডা আর মেক্সিকোকেও ছাড় দেননি ট্রাম্প। এই দুই দেশের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন তিনি। ফলে তিন দেশের মধ্যে যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) আছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ট্রাম্প যেভাবে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থাও ব্যাহত হতে পারে।

এ ছাড়া ব্রিকস জোট যদি নিজেদের মধ্যকার লেনদেনের জন্য ব্রিকস মুদ্রা চালু করে, তাহলে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইএই) পণ্যে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার আদ্যক্ষর নিয়ে গঠন করা হয় ব্রিকস জোট। পরে তাদের সঙ্গে অন্যান্য দেশ যোগ দেয়।

বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে লড়াই

২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশের সরকার বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। বছরের শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ডিজিটাল সার্ভিস ও ডিজিটাল মার্কেট অ্যাক্ট বা আইন জারি করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন বিধিবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্তের ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এরপর মার্চ মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যুগান্তকারী এআই অ্যাক্ট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইনও পাস হয়।

এসব আইন চলতি বছরের আগস্ট মাসে কার্যকর হয়। তবে জাতীয় নিরাপত্তা, সামরিক ও বিশুদ্ধ গবেষণার ক্ষেত্রে আইনগুলোতে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীব্যাপী যত আইন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এখনো সমন্বয় আসেনি।

২০২৪ সালে ব্রাজিল সরকারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের একটি বড় লড়াই হয়ে গেছে। এ যুদ্ধে আপাতত ব্রাজিল সরকারের জয় হয়েছে। আগস্ট মাসে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট এক্স ব্যবহার স্থগিত করার পাশাপাশি এক্স ও ইলন মাস্কের আরেক প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেন। অভিযোগ, কোনো এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ভুল তথ্য সরানো হয়েছে এবং ইলন মাস্ক সেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে রাজি হননি।

নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের নিচের শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের স্বাস্থ্যগত প্রভাবের কথা বিবেচনা করে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

এ ছাড়া টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশে আইন–কানুন মেনে চলার ক্ষেত্রে নানা ঝামেলায় জড়িয়েছে।

বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধি

চলতি বছর ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েনের দাম বেড়েছে ১২০ শতাংশ। মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্প বিটকয়েনের প্রতি সমর্থন জানানোর পর এটির দাম বেড়ে যায়। নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই মুদ্রাটির দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের মতো।

২০২৪ সালে বিটকয়েনের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩৮ হাজার ৫১৪ ডলার আর সর্বোচ্চ দাম উঠে ১ লাখ ৮ হাজার ২৭০ ডলার। নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হবে ক্রিপ্টোকারেন্সির রাজধানী। তাঁর এ ঘোষণার পর দাম বাড়তে শুরু করে মুদ্রাটির।

জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের নতুন নতুন ফ্রন্ট তৈরি হওয়া সত্ত্বেও চলতি বছর তেলের দাম উল্টো ১ দশমিক ৫ শতাংশের মতো কমেছে। বিদায়ী বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ০১ ডলারে ওঠে এবং সর্বনিম্ন ৬৬ দশমিক ৩৭ ডলারে নামে। গতকাল রোববার প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৭০ ডলার।

মূলত চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বাজারে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা উত্তেজনার মধ্যেও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমেছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নেমে যেতে পারে। তেলের দাম কমে যাওয়ায় আমদানিকারী দেশগুলো স্বস্তি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার কমে আসার পেছনে তেলের মূল্য হ্রাসের প্রভাব আছে।

ঋণ বৃদ্ধির খড়্গ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসীমা অতিক্রম করে গেছে আরও আগে। এ নিয়ে চলতি বছর বেশ কয়েকবার শাটডাউনের কবলে পড়ার উপক্রম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশেও সরকারি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি গত কয়েক বছরে বেশ আলোচিত বিষয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ৫৩ শতাংশ উন্নত দেশ ও ৬৪ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের কারণে হতে পারে।

ক্রমবর্ধমান ঋণের সুদ পরিশোধ করতে অনেক দেশ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে পারছে না। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, আগামী কয়েক বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

সূত্র: সিএনএন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, আল–জাজিরা