বেড়েছে রিজার্ভ, কমেছে বকেয়া আমদানি দায়

ডলারছবি: রয়টার্স

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে ডিসেম্বরে। বিদায়ী বছরের শেষ মাসে ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রবাসী আয়ের প্রবাহ জোরালো হওয়ার ধারাবাহিকতায় এক মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এল।

এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। করোনা মহামারির মধ্যে ওই মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৫৯ কোটি ডলার।

গত কয়েক মাসে জোরালো প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এবং বিদেশি ঋণের অর্থছাড়ের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি দায়ের পরিমাণও কমে এসেছে। 

আগস্টে নতুন সরকার গঠনের পর প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। তবে ডিসেম্বরে আসা ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৯৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের চেয়ে বিদায়ী বছরে ২৩ শতাংশ বেশি প্রবাসী আয় দেশে এসেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক থেকে যেনতেনভাবে ঋণ বিতরণ কমে এসেছে, এর ফলে অর্থ পাচারও কমে গেছে। সে কারণে হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রবাসীরা দেশের সংকট মেটাতে আগের চেয়ে বেশি এগিয়ে আসছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দেশের ব্যাংকগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে রেকর্ড আয় এসেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ডলার–সংকট শিগগিরই কেটে যাবে।’ 

  আয়ে বড় উল্লম্ফন

গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ জোরালো হতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় নভেম্বর মাসে প্রবাসী আয় আসে ২২০ কোটি ডলার। গত বছরের নভেম্বরে ১৯৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। সেই হিসাবে নভেম্বরে প্রবাসী আয় বাড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া গত অক্টোবরে দেশে ২৩৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। আর গত সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ডলার এবং আগস্টে ২২২ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে আসে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে প্রবাসী আয় এসেছিল ১ হাজার ৮০ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের একই সময়ে যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। ফলে গত ছয় মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর ২০২৪ সালের পুরো সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি।

প্রবাসী আয় হলো দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। কারণ, এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না অথবা কোনো দায়ও পরিশোধ করতে হয় না। রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। অন্যদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশে ডলারের মজুতও দ্রুত বাড়ে। 

বেড়েছে রিজার্ভ 

গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুত বা রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলার। দীর্ঘদিন পর বিপিএম ৬ হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ দুই হাজার কোটি ডলারের ঘর ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের ৫০ কোটি ডলার রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে সহায়তা করেছে। 

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পুরোনো আমদানি দায় পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছিল। এ কারণে অনেক ব্যাংক বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ডলার কেনে। ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে আগের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠান। 

কমেছে বকেয়া দায়

গত ৫ আগস্ট যখন সরকার পরিবর্তন হয়, তখন দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৩৭০ কোটি ডলার পাওনা ছিল। এর ফলে অনেক ব্যাংক বিদেশিদের কাছে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। একই সময়ে বিদেশি ঋণমান সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রেটিং অবনমন করায় দেশের বাইরের ব্যাংকগুলো বিদেশি মুদ্রা ব্যবহারের সীমা কমিয়ে দেয়।

জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে প্রায় ৩৩০ কোটি ডলারের মেয়াদোত্তীর্ণ দায় শোধ করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে ২৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। তবে এখনো ৪০ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে। এসব দায়ের বিপরীতে হয় মামলা চলমান, না হয় বিরোধ রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো এই দায় আপাতত শোধ করছে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ–আন্দোলনের পর প্রবাসীরা দেশের অর্থনৈতিক সংকট মেটাতে এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া অর্থ পাচার কমার কারণে হুন্ডিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ব্যাংকগুলোও মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি দায় সমন্বয়ের জন্য প্রবাসী আয় সংগ্রহে আগের চেয়ে বেশি নজর দিয়েছে। এর ফলে রেকর্ড প্রবাসী আয় এসেছে। এতে বকেয়া দায় যেমন কমে এসেছে, তেমনি রিজার্ভও বেড়েছে।