বিশ্ব অর্থনীতি ভালো হচ্ছে, দেশে কবে
‘আলো ক্রমে আসিতেছে’—কমলকুমার মজুমদার অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের শুরুই করেছিলেন এভাবে। ২০২৪ সালের অর্থনীতি নিয়ে এখন এমনটাই বলা যায়। অন্তত বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে এই পূর্বাভাসই দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদসহ আইএমএফ, ওইসিডি, জেপি মরগ্যান, এসঅ্যান্ডপি বা গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো প্রতিষ্ঠান।
২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কিছু কমবে। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালে মন্দা এড়াতে পেরেছে, নতুন বছরেও পারবে। বড় পতন ঘটবে না। যাকে বলা হচ্ছে ‘সফট ল্যান্ডিং’। অর্থাৎ কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ছাড়াই মূল্যস্ফীতি তারা আরও কমাতে পারবে। যদিও সরবরাহ সংকট দ্রুত কাটবে না, তবে আরও খারাপ হবে না। কিছু দুশ্চিন্তা আছে চীন নিয়ে, তাদের প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথই থাকবে। তারপরও সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ভালো করবে বলেই পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
এমনিতেও ২০২৩ সালে যতটা ধারণা করা হয়েছিল, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ততটা খারাপ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশির ভাগ দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে। তাই ২০২৪ ঘিরে সবার মনেই আশাবাদ, সে তুলনায় বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদ কম। কমলকুমার মজুমদার লিখেছিলেন, ‘আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনর্ব্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।’ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি ‘ক্রমে আলো আসিতেছে’? আসলে অল্পকাল কবে শেষ হবে।
সরবরাহ সংকট দ্রুত কাটবে না, তবে আরও খারাপ হবে না। কিছু দুশ্চিন্তা আছে চীন নিয়ে, তাদের প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথই থাকবে। তারপরও সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ভালো করবে বলেই পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
সংকট সঙ্গে নিয়েই শুরু
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণ শুরু হয় ২০২০ সাল থেকে, কোভিড–১৯ নামে অতিমারি বিশ্ব অর্থনীতিকে থামিয়ে দিয়েছিল। এরপরের নিষ্ঠুরতা মানুষের তৈরি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের হোঁচট খায়। সেখান থেকে বিশ্ব অর্থনীতি এখনো বের হতে পারেনি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটের কারণ কেবল কোভিড বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয়। সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত, কৃত্রিমভাবে টাকাকে অতিমূল্যায়িত রাখা এবং ভঙ্গুর আর্থিক খাত অর্থনীতির সংকট আরও প্রকট করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক লেনদেনের হিসাবে ভারসাম্যহীনতা। ২০২৪ সাল শুরু হচ্ছে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এসব সংকট নিয়েই।
২০২৩ সাল শুরু হয়েছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। সেই মূল্যস্ফীতি এখন সাড়ে ৯ শতাংশ। এই ১২ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ১২ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মাসে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার করে। বছরের শুরুতে ডলারের দর ছিল ১০৫ টাকা, সেই ডলার এখন কাগজে–কলমে ১১০ টাকা, বাস্তবে প্রায় ১২০ টাকা। নগদ টাকা বা তারল্যসংকটের কারণে কলমানি হার (এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের অর্থ ধার নেওয়ার সুদহার) ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাবে ঘাটতি এখন প্রায় ৪০০ কোটি ডলার, অথচ গত ১২ বছরে আর কখনোই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখেনি বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে রপ্তানি ও প্রবাস আয়েও।
এখান থেকে উত্তরণ কীভাবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। কেননা সংকট তৈরি হয়েছে অনেকগুলো পুঞ্জীভূত কারণে। তা থেকে বের হওয়া সহজ নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে আছে ব্যাংক খাত। এই জিম্মিদশা থেকে বের হওয়ার মতো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে কি না, সেটাও অনেকের প্রশ্ন।
ব্যাংক খাতের লাগাম কার হাতে
২০২২ সাল ছিল সংকটের মূল কারণ এড়ানো বা অস্বীকারের বছর। সব দায় চাপানো হয় কোভিড আর যুদ্ধের ওপর। ওই বছরে বিশ্বের প্রায় সব দেশ যখন মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়িয়েছে আগ্রাসীভাবে, তখনো বাংলাদেশ মুদ্রানীতিকে ব্যবহারই করেনি। ফলে সুদহারের ৯-৬ রাখে সরকার। তাতে তো কোনো কূলেরই রক্ষা হয়নি। বরং সংকট আরও বেড়েছে। ২০২৩ সালে নীতি বদলাতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে বদল আনে।
অর্থনীতির সংকট তীব্র হওয়ায় সরকার অর্থনীতির নানা খাতে পরিবর্তনের চেষ্টা করলেও তেমন জোরোলো কোনো উদ্যোগ ছিল না ব্যাংক খাতে। বিশেষ করে নজরদারির দিক থেকে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংক থেকে নানা উপায়ে অর্থ বের করে নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। পাচার হয়েছে অর্থ। সব মিলিয়ে ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব হারিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরং অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মে নিশ্চুপ থেকেছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে আছে ব্যাংক খাত। এই জিম্মিদশা থেকে বের হওয়ার মতো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে কি না, সেটাও অনেকের প্রশ্ন।
প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট গত ১৪ ডিসেম্বর সংখ্যায় লিখেছে, আবারও ক্ষমতায় আসছে আওয়ামী লীগ সরকার। এই নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ী নেতারা রীতিমতো সভা করে ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন দিয়েছেন। তাঁরা নানা ধরনের সুবিধাও নিয়েছেন ১৫ বছর ধরে। ফলে আবার ক্ষমতায় বসে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন আশাবাদ বিশেষজ্ঞরাও করতে পারছেন না। আর এই আশঙ্কা সত্যি হলে অর্থনীতির ঝুঁকিও থেকে যাবে। অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের নাম আর্থিক খাতের ওপর আস্থাহীনতা। এটা ঠিক করতে হবে নতুন বছরেই।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে এসব বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি অবশ্য দিয়েছে। দলটি বলেছে, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং ব্যাংক যাতে বিধিনির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে, তা নিশ্চিত করা হবে।’ পাশাপাশি ইশতেহারে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমন বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।’ এসব কথা আগেও একাধিকবার বলা হয়েছিল। সুতরাং গত ১৫ বছরে যা করা যায়নি, আগামী ৫ বছরে তা কতটা করতে পারবে সরকার, সেটাও বড় প্রশ্ন।
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে আছে ব্যাংক খাত। এই জিম্মিদশা থেকে বের হওয়ার মতো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে কি না, সেটাও অনেকের প্রশ্ন।
এ খাঁচা ভাঙব কেমন করে
বিদায় নেওয়া বছরটি ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির বছর। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুটি কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। নতুন বছরে আরও দুই কিস্তি ঋণ পাওয়ার কথা। এই ঋণ পেতে ২০২৩ সালে শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হয়েছে। তবে আরও অনেক বেশি শর্ত পূরণ করতে হবে ২০২৪ সালে। এর মধ্যে রয়েছে করছাড় কমানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়, ভর্তুকি যৌক্তিক করা, খেলাপি ঋণ হ্রাস, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তালিকা নিয়মিত প্রকাশ, ব্যাংক খাতের তদারকিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি সুদহারের কাঠামো ঠিক করা; রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি কমানো, ইত্যাদি। অর্থাৎ বেশ কিছু কঠিন সংস্কার করতে হবে সরকারকে। চরকির আলোচিত ওয়েব সিরিজ মাইশেলফ অ্যালেন স্বপনের সংলাপ ধার করে সরকারকে প্রশ্ন করতে হয়, ‘পারবা?’
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এসব সংস্কার করা বেশ কঠিনই হবে। আর আইএমএফও প্রথম দুই কিস্তির সময় যে ছাড় দিয়েছে, নতুন বছরে এতটা নমনীয় হবে না। আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুরও এমনটাই মনে করেন। ফলে নতুন বছরে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে আইএমএফকে সন্তুষ্ট রাখা।
২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার আশঙ্কা খুবই কম। সুদের হার বাড়বে না বলেও মনে করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে। এমন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাদের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার পথ সুগম করবে। তবে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে না। আমাদেরও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।জাহিদ হোসেন
বাড়াতে হবে বিনিয়োগ
২০১৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য স্বস্তির জায়গা ছিল কর্মসংস্থান না কমিয়েই মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা। বাংলাদেশের সংকট এখানেই। ডলার–সংকট এখনো আছে। আমদানির রাশ টেনে রিজার্ভের পতন ঠেকানোর চেষ্টাও খুব ফলপ্রসূ হয়নি। আবার কেবল ৯ শতাংশ সুদহার যে বিনিয়োগ বাড়ায় না, সে প্রমাণও বাংলাদেশ পেয়েছে। আর ছিল অব্যাহত জ্বালানিসংকট। ফলে তিন বছর ধরেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি মন্দাবস্থায়।
অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সবার আগে বিনিয়োগের এই মন্দা থেকে বের হতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা–ও দূর করতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা ঠিক করা। বিশেষ করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দুই বছরে স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। একজন রাজনৈতিক অর্থমন্ত্রী অর্থনীতির নীতি নির্ধারণে কী ভূমিকা রাখবেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে নতুন বছরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অর্থনীতির সংকট কবে কাটবে, এ বিষয়ে অনেকবার কথা বলেছেন। কিন্তু কোনো পূর্বাভাসই মেলেনি। সবশেষে গত নভেম্বর মাসের শুরুতে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। আর খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। এখন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। তাঁর আশাবাদ ছিল, জাতীয় নির্বাচনের পর অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে। মার্চের মধ্যে সংকট কেটে যাবে। আবার গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, জুনের মধ্যেই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।
ঘুরে দাঁড়ানোর জাদুটা কী
অর্থনীতিবিদেরা এতটা আশাবাদী নন। কেননা এ জন্য যেসব উদ্যোগ নিতে হবে, তার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন তাঁরা। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোর কাছে সংকটের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, মোটাদাগে অর্থনীতিতে এখন তিনটি সমস্যা আছে। প্রথম সমস্যা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দ্বিতীয় সমস্যা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা। তৃতীয়টি হলো আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সম্পদের পচন ধরেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের মূলধনের ঘাটতি হয়েছে। এই তিন সমস্যার সমাধান করতে হবে। কেননা, সামষ্টিক অর্থনীতি একধরনের অক্সিজেনের মতো। রোগীর শ্বাসকষ্ট থাকলে অন্য রোগের চিকিৎসার মানে হয় না। আগে রোগীর শ্বাসকষ্ট ঠিক করতে হবে।
নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। এর কিছু লক্ষণও আছে। জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার আশঙ্কা খুবই কম। সুদের হার বাড়বে না বলেও মনে করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে। এমন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাদের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার পথ সুগম করবে। তবে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে না। আমাদেরও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।’
তাহলে কী করতে হবে? জাহিদ হোসেনের মতে, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা আমরা ২০২৩ সালেও করেছি। কিন্তু সেই কৌশল সুফল দেয়নি। যে পথে চলেছি, তা ঠিক ছিল না—এই ভুল কৌশলগুলোর স্বীকৃতি থাকতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বৃদ্ধিসহ কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে। তবে যতটা করা হয়েছে, তা যথেষ্ট কি না; অন্য দেশগুলো আরও কী করছে, তা দেখা উচিত। নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে। বাজার ব্যবস্থাপনাও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেক সময় একেক পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বড় ব্যবসায়ীরা সুযোগসন্ধানী আচরণ দেখাচ্ছেন। বাজার অস্থিরতায় পেছন থেকে যাঁরা ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ডলারের দাম নির্ধারণে বাফেদা ও এবিবি মডেল বাদ দিতে হবে। বৈধ চ্যানেল ডলার প্রবাহ বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতের সব প্রতিষ্ঠান একরকম নয়। আর্থিক খাতে ব্যাপকভাবে আস্থাহীনতা ছড়িয়ে পড়লে অর্থনীতি চালু রাখাই কঠিন হয়। আর্থিক খাতের সমস্যার স্বীকৃতি দেখা যাচ্ছে, কর্মসূচির ঘাটতিও নেই। তবে বাস্তবায়নে অলসতা আছে। কাজের গতি না এলে এই বিষফোড়া একদিন ক্যানসারে পরিণত হতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে বৈধতার সংকট দেখা দিয়েছে, তা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে অর্থনীতির উন্নয়নের দিকেই হয়তো নতুন সরকারের নজর বেশি থাকবে। তবে এ জন্য অনেক বেশি কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সংস্কার করতে হবে। নতুন বছরে এটাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সরকার নেবে কমপক্ষে এই আশাবাদ তো রাখাই যায়।
জীবনানন্দ দাশের ‘স্বপ্নের হাতে’ কবিতার শেষ অংশেই তো বলা আছে, ‘উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,/ মানুষেরো আয়ু শেষ হয়।/ পৃথিবীর পুরানো সে-পথ/ মুছে ফেলে রেখা তার—/কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ/চিরদিন রয়!