রংপুর অঞ্চল
আলু উৎপাদন ও হিমাগারে সংরক্ষণের খরচ এবার বাড়ছে
কেজিতে উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৩৩ টাকা, যা গতবার ছিল ২২ টাকা।
১ লাখ ১ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হচ্ছে।
আলু উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ টন।
চলতি মৌসুমে উচ্চফলনশীল (উফশী) বা হাইব্রিড জাতের আলুর বীজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একই সঙ্গে জমির ভাড়া, শ্রমিকের মজুরিসহ চাষাবাদ এবং হিমাগারের ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে গত মৌসুমের চেয়ে এবার আলু উৎপাদনের খরচ ৫০ শতাংশের মতো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের।
সরেজমিনে সম্প্রতি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৩০ জন আলুচাষি, সাতজন বীজ বিক্রেতা ও হিমাগারের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, সব খরচ হিসাব করলে আলুর উৎপাদন খরচ এবার দেড় থেকে দ্বিগুণ বাড়তে পারে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তাপর্যায়ে আলুর দাম বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুসারে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হচ্ছে জমিতে উচ্চফলনশীল (উফশী) বা হাইব্রিড জাতের আলুবীজ রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। এরপরও অবশ্য অনেকে বীজ রোপণ করেন, যদিও এ রকম ক্ষেত্রে আলুর ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বীজ লাগানোর ৯০ দিনের মধ্যে জমি থেকে আলু তোলা শুরু হয়। সে হিসাবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে এই এলাকায় আলু তোলা শুরু হবে।
রংপুরের চাষিরা জানান, এ বছর তাঁরা জমিতে এস্টারিক্স (লাল), ডায়মন্ড, গ্রানুলাসহ (সাদা) উচ্চফলনশীল কয়েকটি জাতের আলুবীজ লাগিয়েছেন। চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই জমিতে এসব বীজ লাগানো হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে জমিতে বীজ থেকে গাছও গজিয়েছে। এখন মাটি দিয়ে আলুর চারা উঁচু করে বাঁধানোর কাজ চলছে।
উৎপাদন ব্যয় কেজিতেই বাড়ছে ১১ টাকা
তারাগঞ্জের কোরানীপাড়া গ্রামের চাষি ইসরাফিল হোসেন চলতি মৌসুমে ১৫ একর জমিতে উফশী জাতের আলুবীজ লাগিয়েছেন। তিনি জানান, এক একর জমি ইজারা নিতে ৪১ হাজার টাকা, এক হাজার কেজি আলুবীজ কিনতে এক লাখ টাকা, জমি চাষে ৭ হাজার ৫০০ টাকা, শ্রমিকের মজুরি বাবদ ৪ হাজার ৮০০ টাকা, সার কেনায় ১৭ হাজার টাকা ও আলুগাছের গোড়া বাঁধতে আরও ৮ হাজার ৪০০ টাকা এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া চলতি মৌসুমে আলু ওঠানোর আগপর্যন্ত সম্ভাব্য সেচ খরচে (শ্রমিকসহ) চার হাজার টাকা, সার কেনায় ৩ হাজার ১০০ টাকা, কীটনাশকসহ বিভিন্ন ওষুধ ক্রয়ে ১৬ হাজার টাকা এবং আলু উত্তোলনে (শ্রমিকের মজুরি) প্রায় ৯ হাজার ৬০০ টাকা খরচ হতে পারে। তাতে প্রতি একর জমিতে আলু চাষে প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় হবে। এর সঙ্গে আলু হিমাগারে সংরক্ষণ ও পরিবহন ভাড়া এবং মজুরি মিলে আরও ৯২ হাজার টাকার মতো খরচ হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতি একরে ৯ হাজার ২০০ কেজি আলু উৎপাদন হতে পারে। ফলে চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে এক কেজি আলু উৎপাদনে প্রায় ৩৩ টাকা খরচ পড়বে।
এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছিল ১৭ টাকা ২৬ পয়সা।
ইসরাফিল হোসেন জানান, গত বছর প্রতি একর জমিতে আলু উৎপাদনে সর্বমোট খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। তাতে প্রতি কেজিতে (হিমাগার ব্যয়সহ) খরচ পড়েছিল প্রায় ২২ টাকা; অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনের খরচ প্রায় ১১ টাকা বা ৫০ শতাংশ বেড়ে দেড় গুণ হয়েছে।
রংপুরের ১২টি হিমাগারের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর প্রতি বস্তা আলু (৫০ কেজি) সংরক্ষণে হিমাগারে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল ৩০০ টাকা করে। নতুন মৌসুমে এই ভাড়া বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করা হবে। তারাগঞ্জের এনএন হিমাগারের ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম বলেন, সার্বিক খরচ বৃদ্ধির কারণে হিমাগারের ভাড়াও বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের ভাড়া ২ টাকা বাড়িয়ে ৮ টাকা করার পরিকল্পনা করেছে হিমাগার মালিক সমিতি।
কৃষকের লোকসান, নাকি ভোক্তার খরচ বেশি হবে?
প্রথম আলোর দুই প্রতিনিধির সঙ্গে আলাদা আলাপে রংপুর অঞ্চলের অন্তত ৩০ জন আলুচাষি জানিয়েছেন, এ বছর সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় জমিতে আলু লাগিয়ে তাঁরা এখন দুশ্চিন্তায় আছেন। নতুন মৌসুমের আলু মাঠপর্যায়ে ২৫ টাকা ও হিমাগার পর্যায়ে অন্তত ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে না পারলে তাঁদের লোকসান গুনতে হবে।
তারাগঞ্জের ইকরচালীর আলুচাষি কোবায়েদ হোসেন বলেন, ‘এবার আলু উৎপাদনের খরচ বেড়ে গত বছরের তুলনায় অন্তত দেড় গুণ হবে। বিক্রির সময় কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’ আর বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ী গ্রামের চাষি ইয়াছিন আলী বলেন, ‘বেশি দামে বেচন (আলুবীজ) কিনিয়া আলু তো শখে শখে নাগাচি (লাগিয়েছি)। দাম পড়ি গেইলে (কমে গেলে) মরণ ছাড়া উপায় থাকপের নেয় (থাকবে না)। সবায় কওচে, এবার নাকি আলুর দাম কমবে। এইগলা শুনিয়া খুব ভয়ে আছি।’
অন্যদিকে কৃষকেরা বেশি খরচে উৎপাদিত আলু বিক্রি করে মোটামুটি লাভেও বিক্রি করতে পারলে কিন্তু ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যটির দাম বাড়বে। খরচের কোপটা কার ওপর পড়ে, সেটি বোঝা যাবে ফেব্রুয়ারি থেকে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে আলুবীজের চাহিদার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৬০০ টন। ১ লাখ ১ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৭ টন। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার হেক্টরে আলু লাগানো হয়েছে। গত বছরে রংপুরে ১ লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে ২৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৯৩ টন আলু উৎপাদন হয়েছিল।
তারাগঞ্জ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ধীবা রানী রায় বলেন, এ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আলুর চাষ হতে পারে। তবে উৎপাদন খরচটা বেশি পড়বে। এ কারণে ভবিষ্যতে আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে চাষিরা শঙ্কায় রয়েছেন।