ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট
পরীক্ষামূলক পণ্য পরিবহন শেষ হচ্ছে আগামী সপ্তাহে
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে আগে পরীক্ষামূলক তিনটি চালান নেওয়া হয়। আগামী সপ্তাহে ভারতের দুটি চালান আনা–নেওয়া হবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক শেষ দুটি চালান আনা–নেওয়া হবে আগামী সপ্তাহে। ট্রানজিট পণ্য বোঝাই করতে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা কলকাতার শ্যামপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরের পথে রয়েছে। শুক্রবার বন্দরটির জেটিতে জাহাজটি ভিড়ানোর কথা রয়েছে। সেখান থেকে এক কনটেইনার রড নিয়ে আগামী তিন–চার দিনে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা।
চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে সড়কপথে শ্যাওলা (সিলেট)–সুতারকান্দি (ভারত) স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারতের আসামে নেওয়া হবে। সব৴শেষ চায়ের চালানটি ভারতের মেঘালয় থেকে ডাউকি (ভারত)–তামাবিল (বাংলাদেশ) স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে এই চালান কলকাতায় নেওয়ার কথা। এ দুটি চালানের মাধ্যমে পাঁচটি রুট বা পথে ট্রানজিট পণ্য আনা–নেওয়া শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় পরীক্ষামূলক শেষ দুটি চালান আনা-নেওয়া হচ্ছে।
পরীক্ষামূলক চালানগুলোতে পণ্য পরিবহনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে চিহ্নিত করে তা সমাধান করা হবে। এরপর চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের ট্রানজিট পণ্যের আনুষ্ঠানিক চলাচল শুরু হওয়ার কথা।
ট্রানজিট ঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে দুই পক্ষেরই লাভ হবে। এ জন্য যেসব পথে ভারতীয় পণ্য পরিবহন হবে, সেখানে সংস্কারের দরকার হলে তা যৌথ বিনিয়োগ করতে পারলে ভালো।মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ বেশি লাগে। এ জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতে পণ্য আনা–নেওয়া করা যাবে। এই চুক্তির আওতায় পরিচালন পদ্ধতির মান বা এসওপি সই হয় ২০১৯ সালে। এরপর ২০২০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার প্রথম চালান আনা–নেওয়া হয়।
বন্দর দিয়ে যাচ্ছে শেষ দুই চালান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ট্রানজিটের আওতায় পরীক্ষামূলক দুটি চালান আনা–নেওয়া হবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। পণ্য পরিবহনে ব্যবহার করা হবে চট্টগ্রাম–কলকাতা পথে নিয়মিত চলাচলকারী বাংলাদেশি কনটেইনার জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন লেখার সময় জাহাজটি কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরের পথে রয়েছে। শনিবার সেখান থেকে পণ্যবোঝাই করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হবে। জাহাজটিতে ১২৩ একক কনটেইনার পণ্য বোঝাই করা হবে, যার মধ্যে এক কনটেইনারে থাকবে ট্রানজিটের ২৫ টন রড।
মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন শেখ সাহিকুল ইসলাম বলেন, জাহাজটি আগামী মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এরপর ভারতের মেঘালয় থেকে আসা চায়ের একটি চালান নিয়ে কলকাতা বন্দরে যাবে।
প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর
ভারতের ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক চালান পরিবহনে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ট্রানজিটের পণ্য পরিবহনে বন্দরের ওপর চাপ পড়বে না বলে মনে করেন বন্দর কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে আট হাজার কনটেইনার ওঠানো–নামানো হয়।
পরীক্ষামূলক ট্রানজিটে এবার আসছে একটিমাত্র কনটেইনার। তাই ট্রানজিট পুরোদমে চালু হলেও বন্দরের ওপর খুব বেশি চাপ পড়বে না বলে জানান বন্দর কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রানজিটের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে।
কত মাশুল পাবে বাংলাদেশ
গত ২৮ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক আদেশে ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক দুটি চালানের জন্য সাতটি খাতের মাশুল নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে টনপ্রতি ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, সিকিউরিটি খরচ ১০০ টাকা, এসকর্ট বাবদ খরচ ৫০ টাকা, বিবিধ প্রশাসনিক খরচ ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ টনপ্রতি কাস্টমস খরচ ও মাশুল হিসেবে আদায় হবে ৩০০ টাকা। এ হিসাবে ২৫ টন রডবাহী এক কনটেইনারের চালানে কাস্টমস পাবে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে প্রতি কনটেইনার প্রসেসিং ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫৪ টাকা। অর্থাৎ এক কনটেইনারের চালানে কাস্টমস রাজস্ব পাচ্ছে ৭ হাজার ৭৫৪ টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ফাইজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইলেকট্রনিক লক ও সিল চালু না হওয়ায় কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চালানটি পাহারা দিয়ে স্থলবন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাবেন।
কার কী লাভ
ভারতের পোর্ট শিপিং এবং ওয়াটারওয়েজ মন্ত্রণালয়ের গত ২২ আগস্টের এক টুইটে বলা হয়, কলকাতা থেকে উত্তর–পূর্বাঞ্চলের প্রধান শহরগুলোর সড়কপথে দূরত্ব ১ হাজার ২০০ কিলোমিটারের বেশি। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করা হলে এই দূরত্ব অর্ধেকে নেমে আসবে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে দেশটির ব্যবসায়ীদের সময় ও খরচ সাশ্রয় হবে।
ট্রানজিটের পণ্য পরিবহন করে বাংলাদেশের সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে মূলত তিনটি খাতে আয় হবে। প্রথমটি হচ্ছে ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে নানা ধরনের মাশুল ও খরচ। দ্বিতীয়টি ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে বন্দরের সেবা মাশুল। তৃতীয়টি হলো দেশীয় যানে ট্রানজিট পণ্য পরিবহন করে বেসরকারি খাতের আয়।
উপকূলীয় নৌপথে চলাচলকারী দেশীয় কনটেইনার জাহাজ রয়েছে ২৪টি। ফলে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের আয়ও ঘরে আসবে এদেশের ব্যবসায়ীদের।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রানজিট ঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে দুই পক্ষেরই লাভ হবে। এ জন্য যেসব পথে ভারতীয় পণ্য পরিবহন হবে, সেখানে সংস্কারের দরকার হলে তা যৌথ বিনিয়োগ করতে পারলে ভালো।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের চিন্তাভাবনা চলছে। ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের বিষয়টিও সমন্বিতভাবে দেখতে হবে।