স্বাধীনতার পর পেছনে ফিরে তাকায়নি অর্থনীতি

গত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সাহায্যনির্ভর অর্থনীতিটি পরিণত হয়েছে বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতিতে। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। গত পাঁচ দশকে অতিদারিদ্র্যের হার প্রায় এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে এনেছে। সব মিলিয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা এখন বাংলাদেশকে রীতিমতো ‘উন্নয়নের গল্প’ হিসেবে দেখে। অথচ পশ্চিমারা একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি মনে করত। সেই দিন আর নেই।

এসব নিয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিদারিদ্র্য, বিশাল জনগোষ্ঠী, দুর্বল অবকাঠামো, কৃষিজমির সীমাবদ্ধতা—এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় ও দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে। এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা ও বিদেশি সরকার নীতি ও ঋণসহায়তা দিয়েছে। ফলে নানা সমস্যা কাটিয়ে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। ফলে জনগণের মাথাপিছু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বেড়েছে।

মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অপরিসীম। কৃষকেরা দেশকে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন করে ফেলেছেন। বেসরকারি খাতের নেতৃত্বে অর্থনীতি বাজারনির্ভর হয়ে উঠেছে। শুরুর দিকে বিদ্যুৎ, কৃষি, বিমান সংস্থা, খাদ্য, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান—সবই সরকারি ছিল সরকারি মালিকানায়। এখন এসব খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছে বেসরকারি খাত। তাঁর মতে, আগামীর কঠিন পথ পাড়ি দিতে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠার গল্প

এবার দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে বাংলাদেশে উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। তখন পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে দেশে মাত্র ৩১৩টি কারখানা চালু করা সম্ভব হয়। নব্বইয়ের দশকের আগে পর্যন্ত শিল্পকারখানা তেমন একটা গড়ে ওঠেনি।

এরশাদ সরকারের পতনের পর নব্বই দশকের শুরুতে অর্থনীতি উন্মুক্ত করা শুরু হয়। সরকারগুলো নীতি–সহায়তা দিয়ে যায়। মূলত কর অবকাশ সুবিধাসহ নানা কর–সুবিধা; ব্যাংকঋণ সহজ করা; রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনাসহ নানা কারণে এ দেশে গত তিন দশকে বেসরকারি খাতে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়েছে। পোশাকশিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। এ ছাড়া রড-সিমেন্ট, ওষুধসহ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ে একের পর এক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।

উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠার ফলে লাখ লাখ অদক্ষ ও আধা দক্ষ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি গত তিন দশকে মোবাইল ফোন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা খাতের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছে।

২০১৯ সালে কলকারখানা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) উৎপাদন খাতের ওপর একটি জরিপ করে। সেই জরিপে সারা দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি কলকারখানা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পোশাক রপ্তানি: চার লাখ টাকায় শুরু, এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম

রিয়াজ গার্মেন্টস এ দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন ফ্রান্সে মাত্র ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করেন। কেনেন ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁস। ওই শার্টের চালানের দাম ছিল ফরাসি মুদ্রায় মাত্র ১৩ মিলিয়ন ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। সেটিই ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানি।

দেশ স্বাধীনের পর পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল শিল্প খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। বর্তমানে মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি এই খাত থেকেই আসে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয়। বছরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়। দুই হাজারের বেশি কারখানা এখন সরাসরি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। আর এই খাতে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ কর্মী।

মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সালের ১ জুলাইয়ের আগপর্যন্ত বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ ছিল। নিম্ন আয়ের দেশকে সহজ বাংলায় গরিব দেশ বা দরিদ্র দেশ বলা হয়।

২০১৫ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দেয় বিশ্বব্যাংক। মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়ের মাপকাঠিতে বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক তার সদস্যদেশগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করে। এগুলো হলো নিম্ন আয়, মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশ। মধ্যম আয়ের দেশ আবার দুই রকম—নিম্নমধ্যম ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত বা উচ্চ আয়ের দেশ হতে চায়।

এদিকে জাতিসংঘ সদস্যদেশগুলোকে উন্নয়নশীল ও উন্নত—এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করে। তাদের বিবেচনায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হলেও এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় আছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে ‘এলডিসি’ তকমামুক্ত হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যারা এলডিসি থেকে বের হওয়ার তিন মানদণ্ডে একসঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। এটিও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের একটি বড় নির্দেশক।

মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০ গুণ

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪ মার্কিন ডলারের সমান। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে, মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৮৪ কোটি ডলার। তাতে দেখা যায়, গত ৫০ বছরে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। তবে এক হাজার ডলার পেরোতে স্বাধীনতার পর ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪ ডলার হয়। পরের ১১ বছরের মধ্যেই তা দেড় গুণ বৃদ্ধি পায়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দলিল ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ দশকে দেশের জিডিপির আকার বেড়েছে ১ হাজার ১৭৫ গুণ। চলতি বাজারমূল্যের হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।

প্যারিস কনসোর্টিয়াম থেকে ‘উন্নয়ন আড্ডা’

স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। ধারণাটি এমন ছিল, এখানে যতই সাহায্য করা হবে, তা পড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। দাতাদের সাহায্য–সহযোগিতা নিয়েই চলতে হবে।

সরকারি নথি বলছে, ১৯৮১-৮২ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭ শতাংশের সমান বিদেশি সহায়তা নিয়েছিল। বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমে বর্তমানে জিডিপির ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

একসময় বাংলাদেশকে কত সহায়তা দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে দাতারা বছরে একবার বৈঠক করত, যা প্যারিস কনসোর্টিয়াম নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭৪ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রথম এই বৈঠক হয়। এরপর প্রতিবছর বাজেটের আগে এপ্রিল ও মে মাসে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতো। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা চাহিদার ফর্দ নিয়ে ওই বৈঠকে যোগ দিতেন। দাতাদের নানা শর্ত মেনেই টাকা নিতে হতো।

একসময় বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে। ১৯৭২-৭৩ সালে যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নেওয়া হয়েছিল, তার ৭৫ শতাংশই বিদেশি সহায়তানির্ভর ছিল। তখন ঋণের চেয়ে অনুদানের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকেই ধীরে ধীরে বিদেশি সহায়তানির্ভর এডিপি তৈরির প্রবণতা কমতে থাকে। ১০ বছর ধরে প্রতিবছর এডিপির এক-তৃতীয়াংশ খরচ মেটানো হয় বিদেশি সহায়তায়।

গত পাঁচ দশকে দারিদ্র্যের হার ৮৯ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ১১ শতাংশে নেমেছে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, টিকাদান কর্মসূচি, গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়—প্রায় সব সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ বেশ এগিয়েছে।

২০০০ সালের পর থেকেই পরিস্থিতি ঘুরতে শুরু করে। দাতারা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতি দুই বছর অন্তর ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম (বিডিএফ) নামে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ২০০৩ সালে প্রথম বিডিএফ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ নিয়ে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ ‘‘বাস্কেট কেস’’, নো মোর’।

২০২০ সালে বিডিএফ বৈঠকের নামই পাল্টে ফেলা হয়। ওই বছরের ৩০ জানুয়ারি বৈঠকের সমাপনী অধিবেশনে স্থানীয় পরামর্শক গোষ্ঠীর (এলসিজি) তৎকালীন সমন্বয়ক ও ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো বিডিএফ বৈঠককে ‘উন্নয়ন আড্ডা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।