বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়ন করার জন্য সংস্কার জরুরি। তাই এবার সংস্কারমূলক বাজেট চাইতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জ্বালানি খাত এখন দেশের বড় সমস্যার জায়গা। দেশের ২৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে ১২–১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদিত হয় না। কারণ, তেল আনার পয়সা নেই। এই খাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। তার মধ্যে ৩২ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ। এই ভর্তুকি কমানো না হলে তা হবে বৈষম্যমূলক। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনতে মার্জারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাতের আঁধারে আবার মালিকানা বদল হয়ে যাচ্ছে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংক ও জ্বালানি খাতের সংস্কার না হলে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ও এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করা আমাদের জন্য বিপৎসংকুল হয়ে যাবে। আগামী দিনে বাংলাদেশের উন্নয়নের ফুসফুস হবে এই দুটি খাত। ফলে সংস্কারের বাজেট হতে হবে, সুরক্ষার বাজেট হতে হবে। এই সরকারের আমলে যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তৈরি হয়েছে, তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। না হলে দেশ আবার পিছিয়ে পড়বে।’
দেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির যৌথ আয়োজনে ‘কেমন বাজেট চাই’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘রাশিয়া–ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের কারণে আমরা একটু খেই হারিয়ে ফেলেছি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার–সংকট, সুদের হার বৃদ্ধি ও জ্বালানিসংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে আগামী বাজেট ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব করা গুরুত্বপূর্ণ।’
বাংলাদেশ ব্যাংককে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের সমস্যা কী সেটা সবার জানা আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আবার এক দিন পর পরিবর্তন করা হচ্ছে। বুঝেশুনে সমস্যার গভীরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ব্যবসায়ীদের আস্থা থাকবে না। বাজারের আস্থা থাকবে না।
বাজেটে জীবনযাত্রায় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বাজেট জনবান্ধব ও শিল্পবান্ধব হতে হবে। শিল্পায়নের পথে যে বাধা রয়েছে তা সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত করা দরকার বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। এগুলো খুলে দেখার লোকও নেই। কারণ, বাজেটে যন্ত্র কেনার বরাদ্দ রাখা হয়, অথচ এগুলো চালানোর লোক নিয়োগের বরাদ্দ থাকে না। তিনি আরও বলেন, শুধু রোড শো করে পুঁজিবাজারের উন্নতি হবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আমার আত্মীয় ৩০ লাখ টাকা খুইয়েছেন। বড় ধরনের সংস্কার দরকার পুঁজিবাজারে।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও লেনদেনের ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা অর্জন এবং মুদ্রা ও আর্থিক নীতির মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়ে বাজেটে জোর দেওয়ার সুপারিশ করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার। তিনি বলেন, সামনের বাজেট উন্নয়নমুখী হতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গে কোনো আপস নেই। তবে উন্নয়নের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য লাগবে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তিনটি দপ্তর—ট্যাক্স, ভ্যাট ও কাস্টমসকে হয়রানিমুক্ত সেবা দিয়ে ব্যবসা–বাণিজ্যে সহযোগিতা করতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে অগ্রীম আয়কর কর্তনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে। এটি সমন্বয় বা ফেরত না দেওয়া হলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘আমরা একটি উন্নয়ন, সহনীয় ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট চাই। পত্রপত্রিকায় আমরা দেখছি, এবারের বাজেটে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমতে পারে। এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে সেটির সঙ্গে যদি আবার নগদ লেনদেন করা যাবে না কিংবা অল্প পরিমাণ নগদ লেনদেনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কোনো কোম্পানি সুযোগ নিতে পারবে না। কারণ, দেশের ৭০–৮০ শতাংশ ব্যবসাই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের।’
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, আগামী বাজেটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাজেটঘাটতি সহনীয় রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।