২০২২–২৩ অর্থবছর
প্রবাসী আয়ের অর্ধেকই চার জেলায়
দেশে যে প্রবাসী আয় আসছে, তার বড় অংশই ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেটে কেন্দ্রীভূত। সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ছয় জেলা।
দেশের প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশিই মাত্র চার জেলায় কেন্দ্রীভূত। জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট। সর্বশেষ ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে যত প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে, তার ৫২ শতাংশের বেশিই এসেছে এ চার জেলায়। এর মধ্যে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চট্টগ্রামে।
এ জেলায় প্রবাসী আয়ে সর্বশেষ অর্থবছরে প্রায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জেলাভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্য থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১১১ কোটি ডলারই এসেছে উল্লিখিত চার জেলায়। যা ওই অর্থবছরের মোট প্রবাসী আয়ের ৫২ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় এসেছে সর্বোচ্চ ৬৯৭ কোটি ডলার, চট্টগ্রামে ১৬১ কোটি ডলার, কুমিল্লায় প্রায় ১২৯ কোটি ডলার এবং সিলেটে ১২৪ কোটি ডলার। এই চার জেলা ছাড়া দেশের আর কোনো জেলায় শত কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় আসেনি।
জেলাভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত চার জেলায় প্রবাসী আয়ের অংশ ক্রমেই বাড়ছে। ২০২১–২২ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়ের ৪৭ শতাংশ এসেছিল এই চার জেলায়। আর ২০২০–২১ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়ে এই চার জেলার হিস্যা ছিল ৪৯ শতাংশ। সেই হিসাবে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে এ হিস্যা বেড়ে মোট প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি হিস্যা ওই চার জেলা দখল করেছে।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে এই চার জেলার বড় হিস্যার কারণে বিভাগের বিবেচনায়ও এগিয়ে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ। দেশে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে ঢাকা বিভাগে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ। গত অর্থবছরের মোট প্রবাসী আয়ের মধ্যে ১ হাজার ২৪ কোটি ডলার বা ৪৭ শতাংশই এসেছে ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলায়। আর ৫৯৬ কোটি ডলার বা প্রায় ২৮ শতাংশ এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায়। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের চার জেলায় এসেছে ২৪৭ কোটি ডলার বা মোট প্রবাসী আয়ের প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এ চার জেলার মাইগ্রেশন চেইন বা বিদেশে যাওয়া লোকের সংখ্যা বেশি। এ কারণে ঐতিহাসিকভাবে এসব এলাকায় প্রবাসী আয়ও বেশি। আবার প্রবাসে যাওয়া একধরনের বিনিয়োগঘন উদ্যোগ।
বিদেশে যেতে হলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। এ সক্ষমতা পিছিয়ে পড়া জেলার মানুষের ক্ষেত্রে কম। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে উচ্চ আয়শ্রেণির মানুষ বেশি, এসব এলাকার সম্পদমূল্যও বেশি। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মানুষ যত সহজে বিদেশে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগের অর্থ জোগাড় করতে পারেন, অন্য জেলার মানুষের পক্ষে তা জোগাড় করা কষ্টসাধ্য।
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি লোক বা শ্রমিক বিদেশে গেছেন কুমিল্লা জেলা থেকে। গত জানুয়ারি থেকে জুন—এ ছয় মাসে এই জেলা থেকে বিদেশে গেছেন প্রায় ৫১ হাজার লোক। বিদেশযাত্রায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। চট্টগ্রাম থেকে ছয় মাসে বিদেশে গেছেন প্রায় ৩১ হাজার জন। এরপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, চাঁদপুর ও নোয়াখালী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রায় ৩০ হাজার, টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ২৬ হাজার, চাঁদপুর থেকে ২২ হাজার এবং নোয়াখালী থেকে ২১ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন।
কুমিল্লা থেকে বেশি কর্মী বিদেশে যাওয়ার সুফলও মিলছে প্রবাসী আয়ে। এই জেলা এখন প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। কুমিল্লা থেকে বেশি লোক বিদেশে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে দেশে কৃষিভিত্তিক উন্নয়নে এগিয়ে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম কুমিল্লা। এ জেলার বেশির ভাগ কৃষিজমি চার ফসলি। ফলে জমির দামও অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। তাই বিদেশে যাওয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ জেলার লোকেরা এগিয়ে থাকছেন।
সবচেয়ে পিছিয়ে ৬ জেলা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, প্রবাসী আয়প্রাপ্তিতে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ছয়টি জেলা। এর মধ্যে তিনটিই হলো পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। অপর তিনটি জেলা হচ্ছে লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও। সদ্য বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরে এ ছয় জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে বান্দরবানে—মাত্র ১ কোটি ৯৯ লাখ ডলার।
এরপর রয়েছে লালমনিরহাট—এ জেলায় এসেছে ২ কোটি ডলার। এর বাইরে পঞ্চগড়ে এসেছে ২ কোটি ১১ লাখ, খাগড়াছড়িতে এসেছে ২ কোটি ৪৬ লাখ, ঠাকুরগাঁওয়ে ২ কোটি ৭৪ লাখ এবং রাঙামাটি জেলায় এসেছে ২ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয়। এসব জেলা পিছিয়ে থাকলেও সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বান্দরবান, রাঙামাটি, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে আগের বছরের চেয়ে আয় আসা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রবাসী আয় যেকোনো এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় একটি উৎস এ প্রবাসী আয়। তাই ডলার–সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয় বাড়াতে নানামুখী চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে প্রবাসী আয়ের ব্যবহার নিয়ে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রবাসী আয়ের ৩৪ শতাংশ অর্থ ব্যবহৃত হয় প্রবাসীর পরিবারের খাদ্য ও বস্ত্রের পেছনে। ১৯ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করা হয় আবাসন তথা জমি বা ফ্ল্যাট কেনায়। আর ১৮ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করা হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তথা মাছ, মুরগি ও গবাদিপশুর খামারে। ওই গবেষণায় বলা হয়, দেশের দারিদ্র্য বিমোচনেও প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এ কারণে প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে দেশের সব অঞ্চলে সুষম উন্নয়ন বা অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলো থেকে অধিকসংখ্যক মানুষকে বিদেশে প্রেরণে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, এ জন্য সবার আগে দরকার বিদেশযাত্রার খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা।
পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সরকারিভাবে নানা ধরনের সহায়তা প্রদান এবং বিদেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীদের পুনর্বাসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এসব কাজ করতে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে মেগা প্রকল্প বা উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।